দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা নিয়ে দুই বছর ধরে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। জামিনের আবেদন করেও ফল পাননি তাঁর আইনজীবীরা। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। কার্যত খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্যই তাঁদের ওই দাবি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার যেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয় সে কথাও বলা হচ্ছে। তবে সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে।
আইনজীবীরা বলছেন, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির জন্য আইনগতভাবে তিনটি পথ খোলা আছে। একটি হলো আদালতের জামিন আদেশের মাধ্যমে। দ্বিতীয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার মুক্তি দিলে। সে ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। আর তৃতীয় পথ হলো প্যারোল (শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি)। প্রথম দুটি ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আইনজীবীরা জানান, প্যারোলের বিষয়ে সরকার গত বছর নতুন নীতিমালা করেছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে সরকার কিছু সময়ের জন্য মুক্তি দিতে পারে কারাবন্দিকে। তবে প্যারোল পাওয়া ব্যক্তি কোনোভাবেই দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। আইনজীবীরা বলছেন, আপাতত খালেদা জিয়ার প্যারোলের সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে জামিনে কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি মিলতে পারে।
এ কারণে বিএনপির আইনজীবীরা খালেদার চিকিৎসার যুক্তিতে আবারও জামিনের আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলতি সপ্তাহেই এই আবেদন করা হবে। এই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালতের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে খালেদা জিয়া বা তাঁর আইনজীবীদের।
আদালত থেকে জামিন না মিললে সরকারের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে খালেদা জিয়া বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের। আবেদন করা হলে সাজা স্থগিত বা পুরো মওকুফ বা আংশিক মওকুফ করতে পারে সরকার। এ ধারায় সরকারকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৪০১(১) ধারার সুযোগ নিতে হলে খালেদা জিয়া বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যকে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার কোনো আবেদন থাকলেও সরকার সরাসরি মুক্তি দিতে পারবে না। যে আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছেন সেই আদালতের মতামত নিবে হবে সরকারকে। আদালতের মতামত পাওয়ার পর সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, খালেদা জিয়াকে দোষ স্বীকার করে নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। এ ধরনের আবেদন করা হলে এরপর আইন অনুযায়ী সরকার আবেদনটি পাঠাবে নিম্ন আদালতে। যে আদালত কারাদণ্ড দিয়েছেন সেই আদালতের মতামত নিতে হবে। আদালতের মতামত ছাড়া সরকার নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিতে পারবে না।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছেন, খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে তাঁর মুক্তির জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী কারামুক্তির চেষ্টা করতে হবে। বিএনপির কিছু আইনজীবী প্রথম দিকে খন্দকার মাহবুব হোসেনের এই অভিমতের সমালোচনা করলেও এখন সব আইনজীবী এবং দলীয় নেতারাও সুর মিলিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা জামিনের আবেদন প্রস্তুত করেছি। চলতি সপ্তাহেই এ আবেদন করব।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। তাঁর অ্যাডভান্স চিকিৎসা প্রয়োজন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবন বাঁচাতে সরকারের মুক্তি দেওয়া উচিত।’
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান অবশ্য বলেন, দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কোনো আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় মুক্তি দিতে পারবে না সরকার। দুদক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এ জন্য দুদকের অনুমতি নিতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে সাত বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়া। সেই আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। তবে তাঁর জামিনের আবেদন গত বছর ৩১ জুলাই হাইকোর্ট এবং গত বছর ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ খারিজ করেন। এ অবস্থায় নতুন করে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করার উদ্যোগ নিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। সেদিনই তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি। যদিও এ মামলায় হাইকোর্ট ওই বছরের ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ জামিন বহাল রাখেন। তবে অন্য মামলায় জামিন না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পাননি। এ মামলায় হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এক রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এই মামলায় খালেদা জিয়ার করা জামিনের আবেদনও আপিল বিভাগে বিচারাধীন।