রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে মোবাইল-ঘড়িসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমা রেখে প্রতারিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতিহীন এসব হেল্পডেস্ক বসিয়ে এ ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের সামনে এভাবে মোবাইল হাতিয়ে নেওয়ায় বিপাকে পড়েন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা।
প্রতারক সিন্ডিকেটের মূলহোতা মার্কেটিং বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান চঞ্চল ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রাকিব খান। এদের মধ্যে চঞ্চল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। চঞ্চল সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার একনিষ্ঠ কর্মী বলে সূত্র থেকে জানা যায়। তবে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সোহানের ছবি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। পরে জানা যায় সোহান চঞ্চলের সাথে টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধভাবে ওই সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন।
ভুক্তভোগী ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষ করে যখন বের হন ততক্ষণে জমা রাখা বুথের লোকজন লাপাত্তা হয়ে পড়েন। এসময় সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন বিএনসিসির সদস্য ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী জিল্লুর রহমান এবং গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নূর।
গত সোমবার (২১ অক্টোবর) বেলা ১১টা ৪৫ এ অনুষ্ঠিত পরীক্ষা শেষে ১৮-২০ জন পরীক্ষার্থীর বুথে জমা রাখা ফোন হারিয়ে গেছে বলে বিএনসিসির কর্মকর্তাদের নিকট অভিযোগ করেন। পরীক্ষার্থীরা তাদের কাছে অভিযোগ করেন, ভবনের সামনে একটি ডেস্কে ফোন জমা রেখে তারা পরীক্ষা দিতে যায়। ওই ডেস্কে ১০ টাকার বিনিময়ে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে ফোন ও ব্যাগ রাখতে দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা শেষে তাদেরকে ফেরত দেওয়া হবে এই শর্তে তারা ফোন জমা রাখেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিএনসিসি কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমি তখন দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছিলাম। খাওয়া শেষ করে এসে দেখি মোবাইল জমা রাখা বুথের খোঁজ না পেয়ে কয়েকজন ভর্তিচ্ছু মোবাইল-ব্যাগ খুজছে আর কান্না করছে। এসময় তাদের সঙ্গে আরো প্রায় ১৭-১৮ জন ভর্তিচ্ছু আমার কাছে মোবাইল জমা রাখা বুথের খোঁজ নিতে আসেন। কিন্তু ততক্ষনে লাপাত্তা হয়ে যান বুথের দায়িত্বে থাকা লোকজন।
এসময় স্বেচ্ছাসেবকরা পরীক্ষার্থীদেরকে ওই ভবনের পাশে প্রশাসনের বসানো ৭ নম্বর হেল্প ডেস্কে তাদের অভিযোগ জানাতে বলেন।
তবে এ বিষয়ে ৭ নম্বর হেল্প ডেস্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রক্টর সুমন হোসেন বলেন, আমি থাকাকালে এরকম কোন অভিযোগ পাইনি। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ এমন অভিযোগ করেছে বলে আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগ করে থাকলে আমি অবশ্যই জানতাম। কিন্তু বিএনসিসির সদস্যদের জানানোর পরেও নির্বিকার থেকেছেন ভুক্তভোগী ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্ত্বর, ডিনস কমপ্লেক্সের সামনে, শহীদুল্লাহ কলাভবনের পাশেসহ বেশ কয়েকটি যায়গায় প্রশাসনের অনুমতি বিহীন এমন টাকার বিনিময়ে মোবাইল-ব্যাগ জমা রাখা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত ওই ঘটনায় জড়িত অভিযুক্তদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
পরীক্ষা হলে এসব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঢোকার অনুমতি না থাকায় বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে জমা রাখেন ভর্তিচ্ছুরা। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমতো টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ প্রতারণার আশ্রয় নেদ সুযোগসন্ধানী একটি চক্র। তবে ব্যতিক্রমী আয়োজনও ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। গ্রীন ভয়েজ নামের একটি সংগঠন বিনামূল্যে ভর্তিচ্ছুদের ব্যাগ-মোবাইল ইত্যাদি সরঞ্জাম জমা রেখেছেন।
ভর্তিপরীক্ষার প্রথমদিনে অভিযুক্ত আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের সামনে বুথ বসিয়ে ‘মোবাইল, ঘড়ি, ব্যাগ’ জমা রাখছেন এমন এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। এই বুথ বসাতে প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি চঞ্চল ভাইয়ের হয়ে এখানে বসেছি। ভাই আমাকে বসিয়েছেন।’
একইভাবে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ‘মোবাইল, ব্যাগ, ঘড়ি’ জমা রাখছেন মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের সামনের চা-দোকানী নজরুল। একটা মোবাইল বা ঘড়ি যাই রাখুক ১৫-২০ টাকা করে নিয়েছেন তিনি। তারসঙ্গে সহায়তা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই পরীক্ষা চলছে এখন দুটো টাকা ধরে না নিলে কবে নিব? সারাবছর লস দিয়ে ব্যবসা করি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তাকে অনুমতি দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
মোবাইল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মেহেদী হাসান চঞ্চল বলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবন, ২য় বিজ্ঞান এবং ৩য় বিজ্ঞান ভবনের পাশে বুথ ৩টা বসিয়েছি আবার তুলেও ফেলেছি। তবে এ ধরণের কাজের সাথে আমি জড়িত না।’
এ ধরনের বুথ বা যেকোন হেল্প ডেস্ক বসানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান। পরীক্ষার আগের দিন ২০ অক্টোবর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু বুথ ভেঙে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু এরপরও ছাত্রলীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন বুথ বসিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যান।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ডিবির সাথে কথা হচ্ছে এবং তারাই ঘটনা তদন্ত করছে।’