যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়া ১৫ দিনের পুলিশি রিমাণ্ডের প্রথমদিনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাতে ওঠে এসেছে তার গডফাদার-গডমাদারদের তথ্য। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন পাপিয়া। বিস্তার ঘটান অপরাধ জগতের। আর তার এ কাজে সহযোগিতা করেন তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমন ওরফে মতি সুমন।
উঠতি বয়সী মেয়েদের ব্যবহার করে অভিনব কৌশলে টাকা কামাতেন আলোচিত যুব মহিলা লীগ নেত্রী সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। দেশের মেয়েদের পাশাপাশি এ কাজে তিনি ব্যবহার করতেন বিদেশি তরুণীদেরও। ১২ রাশিয়ান তরুণীকে ফাঁদে ফেলে ভিআইপি খদ্দেরদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ কামাতেন তিনি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এমন তথ্য পাপিয়া নিজেই দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
পাপিয়ার বরাত দিয়ে তারা জানান, বিশেষ ক্যামেরা ব্যবহার করে ভিআইপিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ভিডিও করে রাখা হতো। পরে ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের অর্থ। তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, এসব কাজে পাপিয়াকে সহায়তা করতেন তার স্বামী সুমন চৌধুরী। এ সময় ঘনিষ্ঠ অনেক ভিআইপির নামও প্রকাশ করেছেন এই দম্পতি। আর এসব তথ্য পেয়ে বিব্রত হচ্ছেন তারা।
বিমানবন্দর থানায় মঙ্গলবার দিনভর পাপিয়া-সুমন দম্পতিকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে রাজনীতির আড়ালে বাংলাদেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক যৌন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘এসকর্ট’ গড়ে তোলেন যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াই। এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করা হত। কয়েক বছর আগে ‘এসকর্ট’টি গড়ে তোলা হলেও এরই মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিভাগীয় শহরেও।
যৌন ব্যবসার অনলাইনভিত্তিক সাইট ‘এসকর্ট’ এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন সদ্য বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া। কারা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, বিভিন্ন কমিটিতে বড় পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং কারাই বা তার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন- সব তথ্যই এখন তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে।
জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম বলেছেন, যাদের সঙ্গে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে। মূলত এসব নেতাই পাপিয়ার উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপির সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়েও মুখ খুলেছেন পাপিয়া। আর এতেই অনেক রাজনৈতিক নেতার ঘুম হারাম হয়ে গেছে জানা গেছে। পাপিয়ার কাছ থেকে কোন কোন নেতা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন, তাদের নিয়ে দলেও কানাঘুষা চলছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, আইনগত বাধা এড়াতে মামলাটির তদন্ত হাতে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদ করে পাপিয়ার কাছ থেকে আমরা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছি। তিনি বলেন, পাপিয়ার উত্থানের পেছনে কাদের ভূমিকা ছিল, কারা পাপিয়া গংদের কাছ থেকে নিয়মিত সুবিধা নিতেন, তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক রিপোর্ট করছি। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। রাজনীতিতে উত্থানের নিয়ামক হিসেবে দুজন প্রভাবশালী নেত্রীর নাম বলেছেন পাপিয়া।
পরে তারাও নিয়মিত পাপিয়ার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন। তাদের একজন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক এমপি। পাপিয়ার সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসাও রয়েছে। পাপিয়া বলেছেন, বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য অনেক নেতাই তরুণীর জোগান দিতে পাপিয়ার সহায়তা চাইতেন।
ওই নেতাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অনেক ছবিই পাপিয়া কৌশলে তুলে রেখেছেন। ওইসব ছবি দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করতেন পাপিয়া। রাজনীতির আড়ালে এটি ছিল তার মূল ব্যবসা। ওইসব ছবি ব্যবহার করে সমাজের উঁচু স্তরের লোকদের ব্ল্যাকমেইল করা ছাড়াও বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ বাণিজ্য করতেন পাপিয়া।
শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান রুপি ও সাতটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় র্যাব-১ কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম বিমানবন্দর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।