আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী দলীয় মনোনয়ন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ট্রেনে বন্দরনগরীতে ফেরেন। ওই দিন প্রায় ১০ হাজার দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক চট্টগ্রামের পুরনো রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৬ ফেব্রুয়ারি একইভাবে ঢাকা থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ট্রেনে চট্টগ্রামে আসেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। কিন্তু নগরীর ওই রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকে বরণ করতে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি না মেলায় ট্রেনের সাধারণ যাত্রীদের মতোই নীরবে রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন ডা. শাহাদাত হোসেন। ক্ষমতাসীন দলের মেয়র পদপ্রার্থীর জন্য এক ধরনের সুযোগ, আবার প্রতিপক্ষ বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীর জন্য পৃথক ব্যবস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ অভিমত চট্টগ্রামের বিরোধী পক্ষের মেয়র পদপ্রার্থী, রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষের। তারা বলছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ রাখা হয়নি।

আগামী ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হবে আগামী ৯ মার্চ প্রতীক বরাদ্দের পর। এই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার আগেই সরকারি দল আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে নগরীর বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছে তাঁর অনুসারি ও সমর্থকরা। রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে ভোট চেয়ে বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার ও ব্যানার টাঙ্গানো হয়েছে। মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি সরকারি দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও সমানে নিজ নিজ এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। গত শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় নগরীর হালিশহর এলাকায় ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী নুরুল আমিন ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলা চালায় বর্তমান কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থী সাবের আহম্মেদ এবং তাঁর অনুসারিরা। ওই দিন রাতেই সাবের আহম্মেদ ও তাঁর ছেলেসহ ১২ জনের নামে নগরীর ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা করেন নুরুল আমিন। 

অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন এবং দল সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা অনেকটাই চার দেয়ালের মধ্যে তাঁদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে।

গত সোমবার নগরীতে অনুষ্ঠিত যুবলীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রতিনিধিসভায় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চসিকের বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিতর্কিত কয়েকজনকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা জড়িত নই, আমরা কিছুই জানি না।’ নানা অভিযোগ থাকার পরও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারা সমর্থন দিয়েছেন—এই প্রশ্ন উত্থাপন করে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘কারা নেত্রীকে কোণঠাসা করেছেন? নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কারা এসব করেছেন? যাঁরা করেছেন একবারও কি সংগঠনের কথা ভেবেছেন?’ তাঁর এই অভিযোগের বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন। যাঁরা ইতিমধ্যেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের কোনো কিছুই বলা হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মনে করি সব কিছু ঠিকমতো চলছে।’ রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকে জমায়েত করতে দেওয়া হলেও ওই একই স্থানে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের সমর্থকদের দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। এতে প্রশাসন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের ভূমিকার ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’ আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর আগেই তাঁর সমর্থনে নগরীতে ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে প্রচারণা কিভাবে চলে? এই প্রশ্নের জবাবে এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, তাঁর পক্ষে এই ব্যানার-ফেস্টুন কে বা কারা টানিয়েছে তা তিনি জানেন না। তবে নির্বাচন কমিশনের আপত্তির পর এ ধরনের কিছু ব্যানার-ফেস্টুন তিনি সরানোর ব্যবস্থা নেন বলে জানান। নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ (লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করা হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তা হয়েছে বলেই তিনি মনে করেন। তবে বিএনপির কাজ সব সময় অভিযোগ করা। 

চসিক নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি দলের জন্য এক ধরনের নিয়মনীতি। আর আমাদের জন্য প্রশাসনের আরেক ধরনের নিয়মনীতি। পুরো দেশটাই এভাবে চলছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তা মাজিস্ট্রেটরা মনিটর করছেন। কিন্তু শহরজুড়ে সরকারি দলের রঙিন ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। আবার সরকারি দলের নেতারা বলছেন, ‘তাঁরা চট্টগ্রামকে হেলদি সিটি বানাতে চান। অথচ তাঁরাই আবর্জনা তৈরি করছেন। প্রশাসন আমাকে ট্রেন স্টেশনে রিসিভ করার জন্য নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার অনুমতি দিল না। অথচ তার আগে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীকে রিসিভ করার জন্য তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা জড়ো হলো।’       

জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, এখন প্রতিদিনই হোটেলে বসে সরকারি দল আওয়ামী লীগের দুই এমপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেয়র নির্বাচনের বিষয় নিয়ে মিটিং করছেন। কিন্তু প্রশাসন তাঁদের কিছুই বলছে না। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’—এই কথাটি যদি সত্যি হয়, তাহলে ভেবে দেখুন নির্বাচন কেমন হবে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, ‘সিইসি কি ওনাদের পক্ষে বায়াস্ট হয়ে কাজ করছেন?’

সোলায়মান আলম শেঠ জানান, নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে মাত্র পাঁচজনকে রিটার্নিং অফিসারের কাছে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীর সঙ্গে যান ২০ জন।

এদিকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন গত সোমবার এখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি কেন এ আশ্বাস দিলেন? ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে ভয়ের কোনো কারণ কি আছে? জবাবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কালের কণ্ঠকে বলেন, না ভয়ের কোনো কারণ নেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তামূলক সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। আমি সে বিষয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করেছি। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ব্যানার ও ফেস্টুন টানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কাজে ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি অনেক ব্যানার ও ফেস্টুন সরানোর ব্যবস্থা করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না, বিএনপির এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমরা নিরপেক্ষভাবেই কাজ করছি।’    

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও চসিক নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার আতাউর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সবার জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করছি। নিরপেক্ষতার কোনো ঘাটতি নেই। সবাই যেন সমান সুযোগ পায় সে ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।’

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (সিটিএসবি) আবদুল ওয়ারীশ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তারা (বিএনপি) একটি সভা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকায় সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রচারণা যখন শুরু হবে তখন তো সবাই তা করতে পারবে।’ রেলওয়ে স্টেশনে আওয়ামী লীগের জমায়েত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেখানে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা ছিল না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে দুই

এমপির বৈঠক সম্পর্কে সিএমপির এই উপকমিশনার বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে যেসব বিষয়াদি রয়েছে তা নির্বাচন কমিশন দেখে। আমরা শুধু আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখি।’