মোঃ জিল্লুর রহমান
দিনমজুর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে ৪৫ বছর চুল-দাড়ি কাটেননি তিনি। বর্তমানে তার চুল-দাড়ি মাটি ছুঁই ছুঁই। এমনকি ৪৫ বছরে মাথায় তেল ও চিরুনি দেননি। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার আনালিয়া খলিসাকুড়ি গ্রামের মৃত মছির উদ্দিনের ছেলে জহির।
উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ৫৯ নম্বরে থাকলেও সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনি। স্ত্রী মাজেদাকে নিয়ে দুজনের সংসার নিঃসন্তান এই মুক্তিযোদ্ধার। বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিমসহ বাকিদের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত নিজের শরীরের যত্ন নেবেন না বলেও জানিয়েছেন জহির উদ্দিন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়নের আনালিয়া খলিসাকুড়ি গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিনের বয়স ৬৭ বছর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ভারতের শিলিগুড়ি ও মধুপুর ক্যাম্পে তিন মাস প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার উপজেলার সিম্বা গ্রামের মৃত তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাক-বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ৫৯ নম্বরে নাম থাকলেও রহস্যজনক কারণে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত জহির উদ্দিন।
কয়েক বছর আগে জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ৭১ নওগাঁ জেলা শাখা থেকে তাকে দাওয়াতপত্র দেয়া হয়। ইতোপূর্বে কয়েক দফায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেও তালিকায় নাম আসেনি তার। নিজের জমিজমা না থাকায় শ্বশুরবাড়ি একখণ্ড জমিতে মাটির ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। ঘরটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বয়সের ভারে এখন অনেকটাই ন্যুব্জ। বঙ্গবন্ধুর ছবি আর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যানার-পোস্টার দিয়ে শোবার ঘর সাজিয়ে রেখেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত জহির উদ্দিন। যেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কিংবা মিটিং-মিছিল আর আলোচনা হতো সেখানেই হাজির হতেন জহির। তারই ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি।
ভারতের শিলিগুড়ি ও মধুপুর ক্যাম্পে প্রায় তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্প কমান্ডার উপজেলার সিম্বা গ্রামের মৃত তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগ দেন। পরে বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবর শুনে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন জহির। প্রতিজ্ঞা করেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মাথার চুল কাটবেন না। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪৫ বছর। এই বঙ্গবন্ধুপ্রেমী আজ ৬৭ বছরের বৃদ্ধ। দীর্ঘদিন চুল না কাটায় এবং চিরুনি ব্যবহার না করায় মাথার সব চুল জট পাকিয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বলেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু যখন সোনার বাংলা গড়ার কাজে ব্যস্ত ঠিক সেসময় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানার পর রাগে-ক্ষোভে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মেজর ডালিমসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মাথার চুল কাটব না। এমনকি মাথায় তেল ও চিরুনি দেব না। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪৫ বছর। বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন খুনির বিচার হলেও বাকিদের হয়নি। তাদেরও বিচার চাই।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠানোর জন্য ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার যাচাই-বাছাই হয়। কিন্তু অজানা কারণে আমার নাম ওঠেনি তালিকায়। আফসোস, মুক্তিযাদ্ধা হয়েও আজ সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমি।
জহির উদ্দিনের সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান বলেন, যুদ্ধকালীন আমার সঙ্গেই ছিলেন জহির উদ্দিন। তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা; এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি সুযোগ-সুবিধার জন্য আবেদন করলেও রহস্যজনক কারণে আজও বঞ্চিত জহির। অথচ খুবই অভাব-অনটনে দিন কাটছে তার। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম না আসা দুঃখজনক।
জহির উদ্দিনের বিষয়ে জানতে চাইলে রানীনগর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন বলেন, জহির উদ্দিনের নাম আমি কখনও শুনিনি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি না। এমনকি তার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।