বাংলাদেশেও করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাসে যদি কোনো ভিআইপি, বিত্তশালী এবং অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকেরা আক্রান্ত হন, তাহলে তারা কোথায় চিকিৎসা নেবেন? এই বিষয়টি চিন্তা করে তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর জন্য ঢাকার একটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বেসরকারি কয়েকটি বড় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা চলছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল প্রস্তুত করা আর সেসব হাসপাতালগুলোর নাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল সংবাদ নামে একটি গ্রুপের পোস্টে একজন লিখেছেন, ‘ভিআইপিরা শুধু বাঁচার অধিকার রাখেন!’
এই উদ্যোগকে ‘সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল’ বলে পোস্ট দিয়েছেন একজন আইনজীবী। পাবলিক সার্ভিস হেল্প গ্রুপের একটি পোস্টে আরেকজনের মন্তব্য, আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে এই ভিআইপি লোক কারা?
এর আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ব্যাপক যানজটের মধ্যে সড়কে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন তৈরির একটি প্রস্তাব ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাতিল করা হয়। গত বছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে একজন সরকারি কর্মকর্তার জন্য দীর্ঘসময় ফেরি আটকে রাখা এবং ওই ফেরিতে থাকা আহত একজন স্কুল ছাত্রের অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুর ঘটনা সেই সময় ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বর্তমানে মূলত ঢাকার দু’টি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকার আরো কয়েকটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করেছে এসব রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এসব হাসপাতালে আক্রান্ত সব রোগীকেই চিকিৎসা দেওয়ার কথা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ‘ভিআইপি’দের আলাদা হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ভালো সচ্ছল পেশেন্ট আছে না? কথা উঠেছিল তারা কোথায় ভর্তি হতে পারে? সরকারিভাবে আমরা যা করছি, সেগুলো তো আপামর জনগণের জন্য। যে শত শত মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, তাদের জন্যে তো একটা ব্যবস্থা আছেই।
অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ধরুন একজন প্রখ্যাত শিল্পপতি, উনি হয়তো করোনার চিকিৎসায় সরকারি যে ব্যবস্থাপনাগুলো আছে-এগুলোতো সাধারণ মানের-সেখানে যেতে উনি ইতস্তত করলেন। তো উনি অ্যাপোলো (বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতাল), ইউনাইটেড বা স্কয়ারে গেলে যেন চিকিৎসা পায়। তারা টাকা দিয়েই চিকিৎসা করাবেন। তিনি বলেন, এসব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে আগে রাজি হতে হবে।
এখন এভারকেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো হাসপাতাল), ইউনাইটেড বা স্কয়ারের সাথে যাতে একটা বোঝাপড়ায় আসা যায়, তা নিয়ে সরকারের কথাবার্তা চলছে। সরকার আলাপ করছে যাতে পুরো হাসপাতাল অথবা হাসপাতালের একটা ইউনিট করোনাভাইরাস চিকিৎসায় ভিআইপিদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। হাবিবুর রহমানের কাছে প্রশ্ন ছিল ভিআইপিদের মধ্যে আর কারা পড়বেন? এই তালিকায় মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তারাও কি আছেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলছেন, প্রথমে শুধু বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য এ ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছিল।
আমাদের কাছে বারবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ এসেছিল যদি কোনো কূটনীতিক বাংলাদেশে অবস্থানরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাদেরকে কোথায় নেওয়া যায়? এজন্যে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালটা (শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল) নির্ধারণ করা আছে। পরে আমরা চিন্তা করেছি এটাও হতে পারে যে সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক আক্রান্ত হল, তাদেরও ওখানে নেওয়া যেতে পারে, বলছিলেন হাবিবুর রহমান।
সরকারের মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদরাও কি এখানে যাবেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে অবশ্য সরাসরি তিনি কিছু বলেননি। তবে জানা গেছে কিছু হাসপাতালে প্রভাবশালীদের এরই মধ্যে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে, যার মধ্যে সাংবাদিকরাও রয়েছেন।
সাধারণ মানুষের সাথে বৈষম্য?
বাংলাদেশে তথাকথিত ভিআইপি এবং বিত্তশালীরা সাধারণত অসুস্থ হলে বিদেশে চিকিৎসা নিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। দেশে অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবার কারণে সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিতে গিয়ে এরই মধ্যে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। বর্ণনা করেছেন নানান কষ্টের কাহিনি।
ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতরাও অভিযোগ করছেন যে তারা পর্যন্ত যথেষ্ট সুরক্ষা পাচ্ছেন না, আর তাদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতালের সিদ্ধান্তটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী একে ‘সাধারণ মানুষের সাথে বৈষম্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘করোনা প্রতিহত করার একটা পদ্ধতি হলো সামাজিক দূরত্ব। কিন্তু করোনা সামাজিক বৈষম্যও বাড়াচ্ছে। তাদের জন্য তো প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এমনিতেই আছে। আবার তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার মানেটা কি?’
তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। যারা অবস্থাপন্ন, যারা বাইরে চিকিৎসায় যায়, তারা তো বাইরে যেতেই পারে। তারা প্লেন ভাড়া করতে পারে, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাতে পারে। তাদের জন্য আলাদা কিছু করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এতে লোকের বিদ্বেষ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উদাহরণ তৈরি করবেন। অথচ তারাই সর্দি-কাশি হলে বাইরে চিকিৎসা করেন। সেজন্য সাধারণ মানুষও বিলাতে যেতে না পারলেও তখন তার স্বপ্ন হয় কোলকাতা গিয়ে চিকিৎসা করাই। এসব উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা আরো নষ্ট হবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের ভিআইপি সংস্কৃতি
বাংলাদেশে তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতি অনেক পুরনো একটি বিষয়- যেখানে দেশের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাড়তি সুবিধা ভোগ করেন। দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, এটা মূলত ভিআইপি নামটাকে অপব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা নেওয়ার সংস্কৃতি। এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, যা নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস যে ধরনের দুর্যোগ – স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার মধ্যেও যারা স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সুরক্ষার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার মধ্যে ভিআইপিদের জন্য যদি সত্যিই এসব করা হয়, তাহলে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, এমন কোনো শ্রেণির মানুষ নেই, যারা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়েননি। করোনাভাইরাস কোনো বৈষম্য করে না। করোনাভাইরাসে কাছে ভিখারি ও ভিআইপি সবাই সমান। মানুষে মানুষে যে কোনো বৈষম্য নেই, করোনাভাইরাস মানব সভ্যতাকে আর একবার তা মনে করিয়ে দিয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান বিদেশের কিছু রাজনীতিবিদদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর দেশের সবাই যে হাসপাতালে যান, সেসব হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে তথাকথিত ভিআইপি ও প্রভাবশালীরা এমনিতেই চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পান। টিআইবি’র এই শীর্ষ কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়ে বলেন, যারা ভিআইপিদের জন্য আলাদা ব্যবস্থার প্রস্তাব করছেন তাদের উচিৎ হবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা।