করোনা মহামারির এ সময় শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাপনের অনেক কিছুই যখন ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল, তখন হঠাৎ করেই সংকট শুরু হয়েছে রাজধানীতে ঝুলন্ত তার অপসারণকে কেন্দ্র করে। আজ শনিবারের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ইন্টারনেট ও কেবল টিভি নেটওয়ার্কের তার অপসারণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে অথবা এ সমস্যার সমাধান না হলে আগামীকাল রবিবার থেকে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে দেশজুড়ে এই দুটি সেবা বন্ধ রাখবে আইএসপিএবি ও কোয়াব।
গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে তার অপসারণ সমস্যার সমাধান দাবি করে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)। দাবি পূরণ না হলে সারা দেশে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে ইন্টারনেট ডাটা কানেক্টিভিটি এবং কেবল সংযোগ বন্ধ রাখার প্রতীকী কর্মসূচি ঘোষণা করে তারা। সেই কর্মসূচি অনুযায়ী, রবিবার থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশজুড়ে এই দুটি সেবা বন্ধ রাখা হবে।
রাজধানীতে পরিকল্পনাহীন তার অপসারণে শুধু অর্থনীতি নয়, দাপ্তরিক কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। কেবল অপারেটররা ধর্মঘট শুরু করলে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। আলোচনার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে সব পক্ষ।
নানা আপত্তি, অসুবিধা জানানোর পরও থেমে নেই রাজধানীতে ঝুলন্ত তার অপসারণ অভিযান। করা হয়নি বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও। ইন্টারনেট কিংবা স্যাটেলাইট সংযোগ সেবা পেতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ।
কোনো কোনো ইন্টারনেট সেবাদাতা বড় প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের সেবা বন্ধের বিষয়টি জানিয়ে ই-মেইল ও মোবাইলে মেসেজ পাঠানো শুরু করেছে। যেমন—গতকাল শুক্রবার লিংক-৩ টেকনোলজি গ্রাহকদের ই-মেইল পাঠিয়ে রবিবার থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ইন্টারনেটসেবা বন্ধ থাকার বিষয়টি জানায়।
করোনা সংকট মোকাবেলা করে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে সারা বিশ্বই নির্ভর করছে অনলাইন যোগাযোগের ওপর। এ অবস্থায় হঠাৎ করে তার অপসারণে স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক ও দাপ্তরিক নানা কাজকর্ম। দেশের দুই শেয়ারবাজারের লেনদেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রমও হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট না পেলে বন্ধ থাকবে এটিএম সেবাও। এতে শত শত কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি এম এ হাকিম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছি, তা অপরিবর্তিত রয়েছে।’ এ সমস্যার কারণে তো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষও ভোগান্তির শিকার হবে—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পিট দেয়ালে ঠেকে গেছে।’
কোয়াবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার পারভেজও একই কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সিটি মেয়র ও সরকার এই সমস্যা সমাধানে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেবে।’
সংগঠন দুটির দাবি, লাস্ট মাইল কেবলের স্থায়ী সমাধান না করা পর্যন্ত কোনো ঝুলন্ত কেবল বা তার অপসারণ করা যাবে না। আইএসপিএবি, কোয়াব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে লাস্ট মাইল কেবল স্থাপন করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে একটি কমিটির মাধ্যমে সরেজমিনে গিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, রাজধানী ঢাকার প্রায় সব রাস্তার পাশেই মাথার ওপর রয়েছে তারের জঞ্জাল। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব তার ছিঁড়ে মাঝেমাধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে, কখনো কখনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। নগরীর সৌন্দর্যহানির কারণও এই ঝুলন্ত তার। উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঙ্গে থাকা ইন্টারনেট, টেলিফোন ও কেবল সংযোগের তার অপসারণে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে এনটিটিএন অপেরটরদের মাটির নিচ দিয়ে স্থাপিত ফাইবার অপটিক লিংকে সংযোগের মাধ্যমে
ইন্টারনেট ও কেবল সংযোগ সেবার কাজ চালাতে হবে। তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে এক দশক ধরে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। যদিও বেশ কিছু এলাকায় এরই মধ্যে বিদ্যুতের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আইএসপিএবি ও কোয়াবের অভিযোগ, এনটিটিএন অপারেটরদের ‘ফাইবার অপটিক ডাক্ট’ রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর পাশ দিয়ে থাকলেও পাড়া-মহল্লায় নেই। বিভিন্ন অফিস ও বাসা পর্যন্ত লাস্ট মাইল কেবল না থাকায় ওপর দিয়ে তাদের যে তার রয়েছে, তা সরানো সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এনটিটিএন অপারেটররা বলছে, আইএসপিএবি ও কোয়াবের অসহযোগিতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
এনটিটিএন অপারেটর ফাইবার অ্যাট হোমের জনসংযোগ ও রেগুলেটরি বিষয়ক বিভাগের প্রধান আব্বাস ফারুক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা রাজধানীর মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, নিকেতন, গুলশান, বনানী ও মহাখালীতে লাস্ট মাইল সলিউশনের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু ওই সব এলাকায়ও তেমনভাবে সফলতা পাইনি। আইএসপি ও কেবল টিভি অপারেটরটা বাড়তি খরচ এড়াতে অপটিক্যাল ফাইবার ডাক্টে পুরোপুরিভাবে আসছে না। তা ছাড়া বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অনেকে লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে ইন্টারনেটসেবা দিচ্ছে। তাদের নিয়েও সমস্যা রয়েছে।’
উচ্ছেদ অব্যাহত রাখবে ডিএসসিসি : গত ৫ আগস্ট থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা তার অপসারণে অভিযান পরিচালনা করছে। তারা বলছে, করপোরেশন এলাকায় ব্যবসা করতে হলে তাদের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। তারা কেউ সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেয়নি। গত বুধবার পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি ৪৮টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৮৫টি বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ঝুলন্ত তার অপসারণ করেছে। অভিযানের ৪৬তম দিনে গত বৃহস্পতিবার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাত মসজিদ রোডে, বংশাল চৌরাস্তা থেকে বংশাল নতুন রাস্তা পর্যন্ত ৫০০ মিটার অংশে তার অপসারণ করে। এ সময় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ায় এক ব্যক্তিকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে ওই দিন প্রায় এক ট্রাক তার উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
আগামী রবিবারও অবৈধ তার ও স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযান কত দিন ও কোন প্রক্রিয়ায় অব্যাহত রাখা হবে, সে বিষয়ে রবিবার মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে অবৈধ কেবল উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখতে চায় সিটি করপোরেশন।’
করোনার মধ্যে অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অসুবিধায় পড়ছে ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও ক্ষতি হচ্ছে। এসব বিষয়ে সিটি করপোরেশন কী ভাবছে—প্রশ্নের জবাবে আমিন উল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়েও রবিবার আলোচনা হবে।’
ঢাকা উত্তরে ভিন্ন চিত্র : ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র সেবাদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে একেকটি এলাকা বা সড়ক নির্ধারণ করে পর্যায়ক্রমে সেখানকার ঝুলন্ত তার অপসারণ করছেন। এরই মধ্যে উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টরের কয়েকটি সড়ক ও গুলশান এভিনিউর দুই পাশের ঝুলন্ত তার অপসারণ করা হয়েছে।