► করোনায় কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন
► দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত অনেকে

প্রবাসী আয়ে পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এবারও রেকর্ড হয়েছে। ১১ মাসেই ভেঙেছে বিগত বছরগুলোর রেকর্ড। প্রবাসী শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনিতে আলোকিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু সেই প্রবাসীদের অনেকেই ধুঁকছেন অন্ধকারে। স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো মানুষগুলো এখন দুঃস্বপ্নের চোরাবালি থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছেন। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে রয়েছেন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে সরকার এখন অন্য দেশকে ঋণ দেওয়ার মতো সাহস দেখায়। অথচ সেই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা থেকে যাচ্ছেন আলো থেকে দূরে। রিজার্ভের বড় দুটি উত্স হলো পোশাক খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। পোশাক শিল্পে অনেক রকমের প্রণোদনা দেখা গেলেও তেমন কিছুই নেই প্রবাসীদের জন্য। আসন্ন বাজেটে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ এককালীন বিভিন্ন সহযোগিতামূলক পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিচ্ছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (২৭ মে পর্যন্ত) রেমিট্যান্স দুই হাজার ২৬১ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। আগের পুরো অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১১ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ৩৮ শতাংশের বেশি। আর পাঁচ বছর আগের তুলনায় এবার এক মাস বাকি থাকতেই রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।

দেশকে আলোকিত করে তোলা সেই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের দিনকাল কেমন কাটছে?—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। প্রবাসীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে জানা গেছে, দুই দিকেই চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন প্রবাসী কর্মীরা। একদিকে কয়েক লাখ কর্মী দেশে ফিরে আটকে আছেন। অন্যদিকে প্রবাসে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। আবার বৈধ উপায়ে গিয়ে অবৈধ হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। তাঁদের সবারই এখন আয়ের পথ বন্ধ।

গত জানুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) পাড়ি জমান নরসিংদীর বাসিন্দা আল-আমিন এরফান। পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মিলবে কাজ, হয়ে যাবে ভিসাও—এমন আশ্বাসে দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিন লাখ টাকা। অভাবের ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয়ে এখন তিনি ঘুরছেন আমিরাতের পথে পথে। কাজ নেই, ভিসাও নেই। উল্টো কয়েক মাসে উপার্জিত অর্থও কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে সেই দালালচক্র।

ইউএইর শারজাহ শহর থেকে গতকাল সোমবার আল-আমিন কালের কণ্ঠকে জানান, প্রথম মাসেই তাঁকে কাজের ভিসা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওই দালাল। সেই ভরসায় ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও চলে যান আমিরাতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন দালালের ভিন্ন রূপ। আজকাল করতে করতে কেটে যায় চার মাস। ভিসার জন্য আরো তিন হাজার দেরহাম (প্রায় ৭০ হাজার টাকা) তুলে দেন দালালের হাতে। এরপর আর ধরাই দেননি দালাল। দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তিনিসহ মোট সাতজন। প্রত্যেকেই এখন ঘুরছেন অনিশ্চিত পথে।

মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যের কেদাহ নামক এলাকায় থাকেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন। আট বছর ধরে দেশটিতে থাকলেও পরিস্থিতির কারণে এই মুহূর্তে কোনো বৈধ ভিসা নেই তাঁর। করোনা পরিস্থিতির কারণে কয়েক মাস ধরে কাজও নেই। এ অবস্থায় চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। মোশাররফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঠিক কত দিন আগে যে দুই বেলা ভাত খেয়েছি মনে করতে পারি না। প্রবাসজীবনে এমন কষ্টের দিন আর কখনো আসেনি। দেশে ফিরে যাব সেই রাস্তাও নেই। আর দেশে ফিরেই বা কী করব। তাই সব কষ্ট সয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি পাহাড়ে-জঙ্গলে।’

জানা গেছে, ‘আটক কেন্দ্র’ সংখ্যা বাড়িয়ে আবারও অবৈধ প্রবাসীদের ধরপাকড়ে নেমেছে মালয়েশিয়া পুলিশ। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদিনের বরাত দিয়ে মালয়েশীয় গণমাধ্যম বলছে, চলমান লকডাউনের মধ্যেও অবৈধ বিদেশি অভিবাসীদের ধরপাকড় অব্যাহত থাকবে। জাতীয় নিবন্ধকরণ বিভাগ (এনআরডি) ও পুলিশদের সঙ্গে যৌথভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে অভিবাসন বিভাগ।

একে তো কাজ নেই, তার ওপর ধরপাকড় অব্যাহত রাখার ঘোষণায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের মধ্যে। সেলেঙ্গর রাজ্য থেকে নূরউদ্দিন নামে এক প্রবাসী কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা একসঙ্গে আটজন একটি মেসে থাকেন। ছয়জনেরই বৈধ ভিসা নেই। দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে তাঁদের সর্বনাশ হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই তাঁরা কাজ হারিয়েছেন। ধরপাকড় অব্যাহত থাকলে আরো বেকায়দায় পড়তে হবে।

এদিকে অনেক অভিবাসী শ্রমিকের পরিবারেও নেমে এসেছে দুর্দশা। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের বৃদ্ধ জাফর আহাম্মদের ছেলে ফারুক আহাম্মদ থাকেন কাতারে। রাজধানী দোহার একটি রেস্তোরাঁয় চাকরি করতেন ফারুক। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কঠোর লকডাউনে চলে যায় দেশটি। বন্ধ হয়ে যায় রেস্তোরাঁ। চাকরি হারান ফারুক।

জাফর আহাম্মদ টেলিফোনে বলেন, ‘সংসারে ভরণ-পোষণের একমাত্র অবলম্বন আমার ছেলে। খুব বেশি দিন হয়নি সে বিদেশে গেছে। যাওয়ার জন্য যে ঋণ নিয়েছিল তা-ও শোধ হয়নি। এর মধ্যে চাকরি হারিয়ে সে নিজেই বেকায়দায় পড়ে গেছে। আমাদের অবস্থাও খুবই খারাপ। জানি না আমাদের কী হবে।’

যোগাযোগ করা হলে কাতার থেকে ফারুক বলেন, ‘চাকরিটা ফিরে পাইনি। এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি যে ঠিকমতো খাবারও জোটে না। নতুন কোনো চাকরিও পাচ্ছি না। দেশে ফিরে যাব সেই সুযোগও নেই। কারণ বিদেশে আসতে আমাকে অনেক দেনা করতে হয়েছে। দেশে ফিরে দেনা শোধ করব কিভাবে, সংসারই বা চালাব কোন উপায়ে।’

এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরা শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য মতে, গত বছরের এপ্রিল থেকে বিগত এক বছরে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে দেশে ফিরেছেন প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কর্মী। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশফেরত এসব শ্রমিকের ৫৩ শতাংশই দিনমজুরিসহ ছোট কোনো কাজে যুক্ত হয়ে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করছেন। বাকি ৪৭ শতাংশের আয়ের কোনো পথ নেই।

তবে দেশে ফেরা কর্মীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক তথ্য নেই বলে দাবি করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, ‘দেশে ফিরে মানবেতর জীবন যাপন করা কর্মীর সংখ্যা হয়তো বেশি নয়, তার পরও আমরা বিষয়টি স্বীকার করছি। আর আমরা তাদের পাশে আছি। যারা দুস্থ তাদের এ সময় আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের আছে। এটা ঋণ সুবিধা হতে পারে।’

ড. সালেহীন জানান, সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ সেটি হলো—সঠিক ডাটাবেইস না থাকা। বিপাকে পড়া প্রবাসী শ্রমিকদের পুনর্বাসনে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সঠিক তথ্য না থাকায় তাঁদের সহায়তায় এখনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। শিগগিরই দেশে ফিরে আসা কর্মীদের ডাটাবেইস তৈরি করে অসচ্ছলদের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো শ্রমিকই অবৈধ হয়ে বিদেশে যান না। পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা অবৈধ হয়ে যান। যাঁরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কিংবা দেশে ফিরে বেকার হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সবাইকে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এককালীন বিশেষ সহযোগিতা দেওয়া হলে হয়তো তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

সাইফুল হক আরো বলেন, হলমার্কসহ নানা কেলেঙ্কারিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অথচ প্রবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই। প্রবাসীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেটি খুব একটা কাজে আসেনি।

মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড় অব্যাহত থাকার বিষয়ে সৈয়দ সাইফুল বলেন, এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। বাংলাদেশি অভিবাসীরা যেন নিরাপদ থাকেন, সে জন্য সরকার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসতে পারে।