দেশে মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে সুচিকিৎসা পেয়ে রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যেমন ঘটনা আছে, তেমনি অব্যবস্থাপনা ও অপচিকিৎসার অভিযোগও বিস্তর।
এমন বাস্তবতায় মাদকে আসক্ত ব্যক্তিদের বিশ্বমানের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছে ‘ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর পরিচালনায় রয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে রিভারভিউ আবাসিক এলাকার এ কেন্দ্রে শয্যা আছে ৬০টি। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার), একদল দক্ষ কর্মী বাহিনী, স্বনামধন্য টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় এটি গড়ে উঠেছে।
মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি চলবে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে। এর পরিচালক হিসেবে থাকবেন পুলিশ সুপার (এসপি) ডা. এস এম শহীদুল ইসলাম।
কেন্দ্রটি যে সাততলা ভবনে অবস্থিত, সেটির মালিক আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তাদের কাছ থেকে ভবনটি ভাড়া নিয়েছে পুলিশ।
তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়াই এ কেন্দ্রের লক্ষ্য। ১ অক্টোবর থেকে এতে রোগী ভর্তি শুরু হচ্ছে।
কী আছে নিরাময় কেন্দ্রে
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে সাতটি তলা আছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। কোনো রোগী যাতে আত্মহত্যা না করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এসি ও নন-এসি কক্ষ আছে কেন্দ্রে। আছে দুই, তিন ও চার বেডের কেবিন। এতে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রের প্রতি তলায় দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্স থাকবেন। এখানে থাকবে অত্যাধুনিক ডোপ টেস্ট মেশিন ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’।
বর্তমানে শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু গ্যাস প্রমোটো গ্রাফিতে চুল, নাক থেকেও দেহে মাদকের উপস্থিতি বোঝা যাবে।
বর্তমানে মাদক নেওয়ার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এ মেশিনে মাদক গ্রহণ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলে ধরা পড়বে।
ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেডিকেল উইংয়ে আছেন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), মেডিকেল অফিসার, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট, এডিকশন কাউন্সেলর (ইকো ট্রেনিংপ্রাপ্ত), ফ্যামিলি কাউন্সেলর, ফার্মাসিস্ট ও টেকনোলজিস্ট। এখানে রয়েছে ব্যায়াম করার অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি।
ভবনের ওপরে ছাদের একাংশে ফুলের বাগান, অন্য পাশে ব্যায়ামাগার।
মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে যেসব ব্যবস্থা থাকবে, তার অন্যতম কাউন্সেলিং। এর মাধ্যমে মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচার-আচরণে পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে।
বিকল্প চিকিৎসা
চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত অনেক দেশে মাদক নিরাময়ে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে আকুপাংচার বেশ জনপ্রিয়। ওয়েসিসে সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আকুপাংচারের পাশাপাশি মেডিটেশন বা ধ্যানের মাধ্যমে দেহ ও মনের উন্নতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে নিরাময় কেন্দ্রটিতে।
কেন্দ্রটি নিয়ে কী বলছেন আইজিপি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) ইত্তেফাককে বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে ৬০ বেডের হাসপাতালে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে রোগী ভর্তি শুরু হবে।’
মানিকগঞ্জে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আইজিপি বলেন, ‘মানিকগঞ্জে নদীর পাশে ১০ বিঘা জমিতে মাদকাসক্তদের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ বেডের বিশ্বমানের অত্যাধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না।’
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘যারা মাদকাসক্ত, তাদের শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কমে যায় স্মরণশক্তি, স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কোভিডের মতো সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে খুব সহজে।’
পুলিশের উদ্যোগকে স্যালুট জানিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল।
তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সত্যিই ভালো উদ্যোগ। আমরা এই উদ্যোগকে স্যালুট জানাই। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে ডোপ টেস্ট মেশিন আনা হয়েছে, সেটি অত্যাধুনিক।’
মোহিত বলেন, ‘মাদকাসক্তির কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে, নারী নির্যাতন বেড়েছে। এখন থেকে বিয়ের আগে অবশ্যই ডোপ টেস্ট করা উচিত।’
এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘পুলিশে ডোপ টেস্ট করা শুরু হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শুধু পুলিশে কেন? সব প্রতিষ্ঠানেই এটি থাকা উচিত।’
উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। মাদকে আসক্তরা একপর্যায়ে চুরি-ডাকাতি করে। একসময় পেশাদার খুনি হয়ে যায়; স্বাভাবিক আচরণ করে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ কারণে (মাদকাসক্তি) সমাজে খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে। যৌন বিকৃতির ঘটনা ঘটছে। এটা রুখতে হলে আগে মাদকের ডিলারদের রুখতে হবে। একই সঙ্গে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানাই।’