মোঃ মোস্তফা কামাল, ঢাকা:

অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রে জমা পড়েছে। মহানগরের শীর্ষ চার নেতা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে কমিটিগুলো জমা দেন। এরপর থেকে পদপ্রত্যাশীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ কেন্দ্রে চিঠি দিয়েও অভিযোগ করেছেন। চিঠিতে তারা অর্থের বিনিময়ে ‘পদবাণিজ্যে’র অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, পরিবার ও স্বজনরা সম্পর্কের কারণে এবং অন্যরা ‘বিপুল’ অর্থ বিনিয়োগ করে পদ পেয়েছেন। আবার বড় অঙ্কের অর্থ দিয়েও মহানগর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় অনেকে পদ পাননি। এ নিয়ে বাদ পড়া ও ত্যাগী নেতারা থানা-ওয়ার্ডে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে মহানগরের শীর্ষ নেতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কমিটি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত থানা-ওয়ার্ড কমিটি
যথাযথভাবে দিয়েছেন। বাকি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের।

কমিটির সভাপতি পদে রাখা হয়েছে সাবেক ছাত্রদল নেতা হাসান মাহমুদকে। তিনি একসময় ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল সোহেলের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ ও মামলা রয়েছে, ২০১৯সালের ৩০ডিসেম্বর ফেনসিডিল সহ গ্রেফতার হয়েছিলেন।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত শাহজালাল সোহেল কখনও দলের কোনো কমিটি বা পদে ছিলেন না। ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রবাসে থাকা সোহেল দেশে ফিরে রাজনীতিতে যুক্ত হন। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাসিনোকাণ্ডেও তিনি যুক্ত ছিলেন। মাদক মামলার আসামিও তিনি।

প্রস্তাবিত কমিটি প্রসঙ্গে ২০ নং ওয়ার্ড সভাপতি মোনোয়ার হোসেন মনু বলেন, ‘শাহবাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার কমিটিতে শীর্ষ নেতা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে বিএনপির আলোচিত নেতা চৌধুরী আলমের সহযোগী যুবদল নেতা হাসান মাহমুদ ও এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী শাহজালাল সোহেলের নাম! সবার প্রশ্ন, ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে এমন বিতর্কিতদের নাম কেন প্রস্তাব করা হয়েছে? এদের মতো লোককে নেতা বানালে শুধু আমি কেন, দুঃসময়ে সক্রিয় ছিলেন এমন অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়েছে।’ কমিটি নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে দলীয় সভাপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তৃণমূলের এই প্রবীণ নেতা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ৪৫ নং ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবারের সদস্য। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বই ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১-এর ২৮৮ নম্বর পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, শরাফতগঞ্জ ইউনিয়ন শান্তি কমিটির নেতা গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। আর এই গিয়াস উদ্দিন হচ্ছেন কমিটির প্রস্তাবিত সভাপতি হাসান আসকরির আপন মামা এবং প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহার আপন চাচা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে আপন মামাতো-ফুপাতো ভাই। তারা পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দাও। এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে প্রস্তাবিত সভাপতি হাসান আসকরির বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এই এলাকায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর। অনেকেরই অভিযোগ, অতীতে কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলেও সরাসরি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাবিত হওয়ার পেছনে রয়েছে ‘পদবাণিজ্যের মধু’। শিবু ঘোষ নামে আওয়ামী লীগের এক সমর্থক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে প্রস্তাবিত এ দুজনকে ‘রাজাকারের পিওর সন্তান’ আখ্যা দিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর ছেলে, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরবের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ওয়ার্ড শাখার সভাপতি হিসেবে। অন্যদিকে লালবাগ থানার সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে কাউন্সিলর মকবুল হোসেনের নাম। যিনি দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ভাই। আবার হুমায়ুন কবিরেরই আপন ভাগনে বখতিয়ার হোসেনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। এ থেকে অনেকেই অভিযোগ করছেন, দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংগঠনকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির কে মুঠোফোনে জানতে চাইলে বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে যোগ্যতা থাকলে পদ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। সব দলেই এমন নজির আছে।’ কমিটি নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তো শুধু প্রস্তাব দিয়েছি। এই পুরো কমিটিই যদি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন কমিটি দেওয়া হয়, তাতেও আমাদের কিন্তু কোনো আপত্তি নেই। ৭৫টা ওয়ার্ড ও ২৪টা থানায় প্রার্থী হাজার হাজার। কেন্দ্র থেকে যাচাই-বাছাই করে যাকেই দেওয়া হোক, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। পদবাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এ বিষয়ে সাক্ষাতে আলোচনা করব, ফোনে নয়।’