পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন মহাবনে সম্প্রতি যে আগুন লেগেছে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামাচ্ছে ব্রাজিল। দেশটির রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি এমন একটি আদেশ জারি করেছেন। আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রাজিল কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বিশ্বব্যাপি এমন অভিযোগ ওঠে। এরপরই সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় ব্রাজিল।
অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে আগুন নিয়ে আলোচনা হলেও তা নেভানের জন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। তবে এ কাজে প্রথম এগিয়ে আসে বলিভিয়া। খবর বিবিসি’র।
বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেস আগেই সাহায্যের কথা বলেছিলেন ব্রাজিলকে। কিন্তু তখনও সেভাবে টনক নড়েনি ব্রাজিল সরকারের। দাবানলের ছড়িয়ে পড়া রুখতে সুপার ট্যাঙ্কার বোয়িং বিমান ৭৪৭-৪০০ ভাড়া করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন ইভো। গতকাল শুক্রবার থেকে আগুন আয়ত্বে আনতে আকাশ পথে ঐ ট্যাঙ্কার নিয়ে অভিযানও শুরু হয়েছে।
বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট আলভারো গার্সিয়া জানিয়েছেন, দেড় লাখ লিটার পানি বা অগ্নি নির্বাপক নিয়ে উড্ডয়নে সক্ষম এই সুপারট্যাংকার বোয়িং বিমান। এই বিমান থেকে পুড়তে থাকা আমাজনে পানি ঢালা হবে। তার আগে বিমানবাহিনীর বিমান গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আসবে। এরপরই পানি নিয়ে উড়াল দেবে সুপার ট্যাংকার বোয়িং বিমান।
জানা যায়, পরিবেশ, আদি ভূমি এবং সীমান্তবর্তী এলাকা সংরক্ষণে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছে ব্রাজিল। ইউরোপিয়ান নেতাদের দেয়া প্রচণ্ড চাপের পরই এমন সিদ্ধান্ত নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। এর আগে আমাজন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তিনি এই বন রক্ষায় উদাসীন উল্লেখ করে সমালোচনা করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা। পরবর্তীতে ফ্রান্স এবং আয়ারল্যান্ড আমাজনের দাবানল নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্নের হুমকি দেয়। মূলত এরপরই একটু নড়ে বসেন বলসোনারো এবং সেনাবাহিনী নামানোর আদেশ জারি করেন।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদের পাশে প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল রেইন ফরেস্ট আমাজন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশেরই উৎপত্তি আমাজনে। গবেষকদের মতে এই বন প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ডাকা হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে। কিন্তু ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত এ আমাজন আজ বিপন্ন প্রায়। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ গ্রাস করছে ওই চিরহরিৎ বনভূমিকে। গত তিন সপ্তাহ ধরে জঙ্গলটিতে জ্বলতে থাকা আগুনে এরই মধ্যেই পুড়ে গেছে ৭ হাজার ৭৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা।
পৃথিবীর সবচেয়ে জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই অরণ্যে ২৫ লাখের বেশি পতঙ্গের প্রজাতি, ৪০ হাজারের বেশি গাছের প্রজাতি, দু’হাজার পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রজাতি এবং ২ হাজার ২০০ প্রজাতির মাছের বাস। বিভিন্ন নাম না জানা মানব গোষ্ঠীর বাসস্থান। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তারাও।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (ইনপে) ২০১৩ সাল থেকে আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগা নিয়ে গবেষণা করছে। চলতি বছর আমাজন রেইন ফরেস্টে ৭২ হাজার ৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এই প্রকোপ আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে বলে দাবি ইনপে-র। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে রেকর্ড হারে পুড়ছে অ্যামাজন জঙ্গল। এরইমধ্যে ব্রাজিলের রোন্ডানিয়া, অ্যামাজোনাস, পারা, মাতো গ্রোসো অঞ্চলের কিছু অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
আগুনের কারণে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে সূর্যের মুখ। এমনকি দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলোর দুপুরের আকাশ যেন ‘রাতের চেয়েও অন্ধকার’ হয়ে উঠেছে আগুনের ধোঁয়ায়। ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর আকাশেও হানা দিয়েছে ধোঁয়া।
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজনে ঘটতে থাকা ৯ হাজার ৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। আমাজনের আগুনের ওপর নজর রাখছে নাসা। আগুনের তীব্রতার ছবিও পাঠাচ্ছে নাসার একাধিক স্যাটেলাইট। তবে আগুনের থেকেও বিজ্ঞানীদের বেশি ভাবাচ্ছে আগুন থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া।
আমাজনে আগুন লাগা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কিন্তু এবারের মতো ভয়াবহরূপে আগে কখনও আগুন ছড়ায়নি জঙ্গলে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে।
অঞ্চলটিকে ঘিরে করা কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কথিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য কৃষির বিস্তৃতি, বৈধ ও অবৈধ খনি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য ঘটছে অরণ্য বিনাশ। গত কয়েক দিনের আগুন কথিত উন্নয়নের জন্য অরণ্য বিনাশের গতিকেই জোরদার করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।