ঐক্যবদ্ধ থেকে খালেদাকে মুক্ত করাই চ্যালেঞ্জ
ঐক্যবদ্ধ থেকে খালেদাকে মুক্ত করাই চ্যালেঞ্জ

একচল্লিশ বছর আগে দেশের ক্রান্তিকালে ক্ষমতার উত্থান-পতনের মধ্যে পথচলা শুরু হয়েছিল বিএনপির। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় কঠিন সময় মোকাবিলা করে তিনবার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে দলটি। সেই দল এখন ‘মহাসংকট’কাল অতিক্রম করছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রায় দেড় বছর কারা-অন্তরীণ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কারাদ- নিয়ে বিদেশে আছেন। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ তৈরি হয়েছে। অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারে নেতাকর্মীরা অনেকটা দিগ্ভ্রান্ত। এই চরম সংকটকালে দলের ঐক্য ধরে রেখে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে ‘অবিশ্বাস্য’ভাবে পরাজিত হয় বিএনপি। ২০০৭ থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত। এরই মধ্যে দলকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে পুনর্গঠনে হাত দিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। চলতি বছরের শেষে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে কাজ চলছে।

এ বাস্তবতায় আজ ১ সেপ্টেম্বর রবিবার বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এ দিনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দলীয় কার্যালয়ে আজ ভোরে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল ১০টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা শেরেবাংলানগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা হবে। এ ছাড়াও কাল সোমবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশে র‌্যালি কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

দলীয় নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে নিতে হয়। সেই চিন্তা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি দুটিই দলটির থাকতে হয়। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর দলটিতে এসব অভাব দারুণভাবে ফুটে ওঠে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করলেও তিনি সর্বজনীন নেতা হিসাবে এখনো নেতাকর্মীদের কাছে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। এ ছাড়াও ওয়ান-ইলেভেনের রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে সেখান থেকে বের হতে পারেনি দলটি।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমানে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে বিভক্ত। নির্বাচনের সময় গঠন করা ঐক্যফ্রন্টও কার্যকর নয়। ফ্রন্টে নেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দল। ২০-দলীয় জোটও ছেড়ে গেছেন বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, নানা সময়ে বিএনপি বিপর্যয়ে পড়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একাদশ নির্বাচনের পর বিএনপি আবারও নতুন করে সংকটে পড়ছে। এ সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপিকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। যোগ্য এবং ত্যাগীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে হবে। নতুন নেতৃত্বকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষদের এক মঞ্চে এনে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে। এই দলটির ৪১ বছরের ইতিহাসে ৩৮ বছর ধরে চেয়ারপারসন হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন খালেদা জিয়া। চারবার ক্ষমতায় ও দুইবার বিরোধী দলে ছিল দলটি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর পাঁচ বছর সংসদের বাইরে ছিল।

চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আবারও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলসহ সরকার বিরোধী অন্য দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। দৃশ্যমান কোনো বৈঠক বা সভা না হলেও নিজেদের মধ্যে নেতারা এ ব্যাপারে আলোচনা করছেন। পুনরায় নির্বাচন আদায়ের দাবিতে বিএনপি আরেকটি বড় জোট গড়তে চায়।

একাদশ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর বিএনপি আন্দোলনমুখী না হয়ে আবার দল পুনর্গঠনের কাজে নেমেছে। আগামী ডিসেম্বরে মধ্যে সপ্তম কাউন্সিল অনুষ্ঠানের চিন্তা করা হচ্ছে। তার আগে সাংগঠনিক জেলাগুলোয় নতুন কমিটি দেওয়া হচ্ছে। অঙ্গসংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নেতাকর্মীদের মধ্যে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনটি বিভাগে দলটি সমাবেশ করেছে।

দলটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, চেয়ারপারসনকে মুক্ত করে দ্রুত আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করাই তাদের টার্গেট। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে বিএনপি যে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করেছে, তা নিয়েই তারা অগ্রসর হবেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমে উচিত দলকে সুসংহত করা; জিয়াউর রহমানের আদর্শে সবাইকে উজ্জীবিত করা এবং ওই যৌক্তিকতায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করা। দলকে সংঘবদ্ধ করা।

বিএনপির কিছু ভুলও রয়েছে মন্তব্য করে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে থাকা বিএনপির মারাত্মক ভুল। এ ছাড়া একতাবদ্ধ না হওয়া ও জনগণকে সম্পৃক্ত না করাটাও বিএনপির রাজনীতির নেতিবাচক দিক। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জানতে চাইলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কোনো উপায় নেই বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর, অনেকটা অনুপস্থিত। গণতন্ত্র উদ্ধার আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্য এখনো আমাদের মধ্যে জাগ্রত। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার সংগ্রামেই আছি আমরা।’

অনেকেই মনে করেন, স্বাধীনতার পক্ষের এ দলটি যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করায় রাজনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যে কোনো চ্যালেঞ্জের সময় প্রতিপক্ষরা বারবার জামায়াতকে সামনে এনে বিএনপিকে ধরাশায়ী করেছে। দেশের বড় একটি অংশও বিএনপির এই কৌশলকে পছন্দ করছেন না। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ত্যাগ করে দলটিকে আপন শক্তিকে বলীয়ান হতে হবে। তা হলে দেশের সুশীল সমাজসহ বড় একটি অংশের সমর্থন বিএনপি পাবে।

জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারলে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না।