ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে মাওয়া চৌরাস্তা থেকে সোজাসুজি দক্ষিণেই পদ্মাপার। পারঘেঁষা অংশটি আগের মতো আর মুক্ত প্রান্তরের মতো নয়। পার ঘেঁষেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়ার মূল সেতু ও নদীশাসনের কর্মযজ্ঞ চলছে। প্রকল্প এলাকার জন্য তৈরি করা ছিমছাম পথে সাধারণের প্রবেশ ‘সম্পূর্ণ নিষেধ’। আগে থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পথ চলতে হলো। গাড়িতে চলতে চলতে চোখে পড়ল পার ঘেঁষে কোথাও স্তূপ করে রাখা হয়েছে সেতুর ওপর গাড়ি চলার জন্য সবচেয়ে ওপরের কাঠামো তৈরির স্ল্যাব, কোথাও রাখা হয়েছে রেলপথে বসানোর জন্য সারি সারি স্ল্যাব।

পার থেকে পদ্মা নদীর দিকে সেতুর অ্যালাইনমেন্ট ধরে এগোতে গিয়ে মাটির ওপর ও নদীর ওপরে নির্মিত অবকাঠামো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ৪২টি খুঁটিতে ৪১টি স্প্যান বসাতে হবে। এর মধ্যে ১৮টি খুঁটিতে স্প্যান বসানো হয়েছে ১৪টি। মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে সেতুর দুই হাজার ১০০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে মাওয়ার দোগাছি থেকে গাড়িতে করে প্রকল্প এলাকায় যাওয়ার আগেই যেন অভিনন্দন জানাল উঁচু ও পুরো সড়কের এপার থেকে ওপারজুড়ে ভিত গেড়ে ওঠা টোল প্লাজা। পড়ন্ত রোদে ঝিলিক দিচ্ছিল টোল প্লাজা কিংবা মাওয়া সংযোগ সড়ক। ছুটছিল পাথর নিয়ে ভারী ট্রাক, ছুটছিলেন মাথায় নিরাপত্তা টুপি পরা শ্রমিকরা।

মাওয়া চৌরাস্তা থেকে প্রকল্প এলাকার ভেতর ঢোকার আগে থেকেই নজর কাড়ছিল ওপরের দিকে বিভিন্নভাবে বেড়ে যেতে থাকা অবকাঠামোগুলো। প্রকৌশলীদের নিয়মিত অনুশাসনে, নির্দিষ্ট বাঁকে, উচ্চতায়, প্রস্থে নিজেদের প্রকাশ করছিল ওগুলো। সঙ্গে থাকা প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানালেন, এগুলোর নাম ভায়াডাক্ট। মানে, এ অংশ হলো ‘সেতুর গোড়া’ বা সেতুর সংযোগ সড়ক, যা মাটির ওপরই নির্মাণ করা হয়েছে।

মাওয়ার পদ্মাপাড়ে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড দুই কিলোমিটারজুড়ে। পাইল তৈরি বহু আগেই শুরু হয়েছিল এখানে। এর কাছেই ‘ট্রাস ফ্যাব্রিকেশন ইয়ার্ড’, সেখানে সেতুর ওপর বসানোর কাঠামো ‘স্প্যান’ তৈরি হচ্ছে। স্প্যান হলো দুটি খুঁটির দূরত্বের মধ্যে বসানোর জন্য কাঠামো, যার মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। চীন থেকে আনা মেম্বার ও জয়েন্ট একসঙ্গে জোড়া দিয়ে স্প্যানের কাঠামোর পূর্ণতা দেওয়া হচ্ছে। একটি স্প্যানে লাগে ১২৯টি মেম্বার। প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার দীর্ঘ।

আরো পাঁচটি স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি : সেতুর ৪১টির মধ্যে ১৪টি স্প্যান বসানো হয়েছে। আরো পাঁচটি স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি চলছে। বর্ষায় পদ্মা উত্তাল থাকায় এগুলো বসানো যায়নি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, মাওয়া ও জাজিরার মধ্যস্থলে ২৪ ও ২৫ নম্বর খুঁটির দূরত্বের মধ্যে ১৫তম স্প্যানটি বসানোর সম্ভাবনা বেশি। চীন থেকে ২৭টি স্প্যান মাওয়ায় পৌঁছেছে এরই মধ্যে।

সড়ক ও রেল স্ল্যাব তৈরি চলছে : সেতুটি হবে দোতলা। ওপরে সড়কপথ ও নিচে থাকবে রেলপথ। সড়কপথের ওপরের অংশ নির্মাণের জন্য স্ল্যাব তৈরি হচ্ছে পুরোদমে। এসব স্ল্যাব তৈরি করে রাখা হচ্ছে প্রকল্প এলাকায়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সেতুর স্প্যান বসানোর পর স্ল্যাব বসাতে হচ্ছে। সড়কপথে দুই হাজার ৯৩১টি স্ল্যাব বসানো হবে, এর মধ্যে এক হাজার ৩৭০টি তৈরি শেষ হয়েছে। নিচে রেলপথে স্ল্যাব বসানো হবে দুই হাজার ৯৫৯টি, এর মধ্যে দুই হাজার ৮১৯টি তৈরি শেষ হয়েছে।

মাওয়া প্রকল্প এলাকা দেখার পর মাওয়ার এমবিইসি জেটিতে গেলে দেখা যায়, একের পর এক স্পিডবোটে প্রকল্প কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা আসা-যাওয়া করছেন। জেটিতে নোঙর করা স্পিডবোটে চেপে পদ্মার বুক চিরে চলতে গিয়ে ঝিলিক দিচ্ছিল সেতুর স্প্যানগুলো। কোথাও ড্রেজারে মাটি তোলা হচ্ছিল। কোথাও ক্রেন ছিল সচল। একটু ঘুরপথে প্রায় ২০ মিনিটে পৌঁছা গেল জাজিরায়। জাজিরায় ফকিরকান্দিতে ৪১ ও ৪২ নম্বর খুঁটিতে স্প্যানের ভেতরে সড়ক ও রেল স্ল্যাব বসানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে সেতুর অংশের ওপরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখা গেল, স্প্যানের ভেতর সড়কপথ তৈরি হয়েছে। সড়কপথ নির্মাণের ৩৯টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে। তার নিচে নিচে ৩২২টি রেল স্ল্যাব বসানো হয়েছে। বোঝা গেল, এ স্প্যানে সেতুর অবকাঠামোর শেষ প্রক্রিয়া চলছে। এভাবে সব স্প্যানের শেষ প্রক্রিয়া শেষ হলে সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু করতে বাধা থাকবে না। নদীতে চলার পথে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেখালেন, বিদ্যুৎ বিভাগের সাতটি খুঁটি বসানোর কাজও চলছে।

মাওয়া ও জাজিরায় সংযোগ সেতু বা ভায়াডাক্ট নির্মাণকাজও এগোচ্ছে। নদীতে দেখা গেল, মূল সেতুর ১১টি খুঁটিতে ঢালাইয়ের কাজ চলছে। সেতুর ২৯৪টি পাইল বসানো হয়েছে।

মূল সেতু নির্মাণ করছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি (এমবিইসি)। নদীশাসনের কাজ করছে সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে।

বসানো ১৪টির মধ্যে মাওয়ায় ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে একটি স্প্যান। নদীর বুকে স্পিডবোটে যেতে যেতে নজর কাড়ল ১৩ থেকে ১৬ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয়েছে তিনটি স্প্যান।

আবার আরো একটি স্প্যান চোখে পড়ল ২০ থেকে ২১ নম্বর খুঁটিতে। তবে ৩৩ থেকে ৪২ নম্বর খুঁটিতে আছে টানা ৯টি স্প্যান একের পর এক। সেতুর অবয়ব এখানে পুরো মাত্রায় ফুটে উঠেছে। জাজিরায় ৩৩ থেকে ৪২ নম্বর খুঁটিতে সেতুর অবয়ব দেখে ভীষণ খুশি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মুহম্মদ এরশাদ। গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে সেতুর কাঠামোর নিচে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, সেতুর পাথর পরিবহনের জন্য ১০টি জাহাজ আছে। দুই বছর ধরে তিনি জাহাজ চালিয়ে পাথর আনছেন প্রকল্প এলাকায়। কাওড়াকান্দি থেকে মাঝিকান্দিতে পাথর আনতে হয়। বললেন, চোখের সামনেই সেতু হয়ে যাচ্ছে।

নদীর ওপর প্রকল্প এলাকা ঘুরিয়ে বেড়ানো স্পিডবোটের চালক আনছার আলী বলেন, ‘আমার বাড়ি মাদারীপুরেই। পদ্মার মতো নদীর ওপর যে সেতু হচ্ছে, সেটাই অবাক হওয়ার মতো ঘটনা।’

বাংলাদেশ সেতু বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতির তথ্যানুসারে, এ প্রকল্পের মূল সেতুর বাস্তব কাজ হয়েছে ৮৩.৫০ শতাংশ। মূল সেতুর সব কয়টি খুঁটির ড্রাইভিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরায় সেতুর সংযোগের অংশ ভায়াডাক্টের পাইলিং ও খুঁটি বসানো শেষ হয়েছে। এখন পিয়ার ক্যাপের কাজ শেষ পর্যায়ে ও গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। মূল সেতুর নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আট হাজার ৯০৩.৪২ কোটি টাকা। নদীশাসন কাজ এগিয়েছে ৬২.৫০ শতাংশ। ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন কাজের মধ্যে ৬ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। নদীশাসন কাজের চুক্তিমূল্য আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে চার হাজার ২১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। দুই প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৩.৫০ শতাংশ।

টোল দিতে থামতে হবে না : বাংলাদেশ সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন, পদ্মা সেতু ২০২১ সালের জুন নাগাদ যান চলাচলের জন্য চালু করা সম্ভব হবে। এ সেতুর পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন’ (কেইসি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, পদ্মা সেতুর টোল আদায়ে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) পদ্ধতি চালু করা হবে। কোনো যানবাহনকে টোল বুথে থামতে হবে না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ট্রাফিক ইনফরমেশন অ্যাপ্লিকেশন চালু করা হবে। তাতে প্রতি মুহূর্তে সড়ক, সেতু বা এর আওতাধীন অন্য যেকোনো অবস্থানে বিদ্যমান যানবাহনসংক্রান্ত তথ্যাদি মোবাইল ফোন, বেতার বা অন্য কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে জানা যাবে।

বড় ভূমিকম্পেও টলবে না : সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, যদি কখনো রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ঠিক তখনই যদি সেতুর খুঁটির নিচ থেকে ৬২ মিটার মাটি সরে যায়, একই সময়ে যদি পুরো সেতু ট্রেন ও সড়কযানে পূর্ণ থাকে, ওই সময় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ওজনের আরো একটি জাহাজ সেতুর খুঁটিতে ধাক্কা দিলেও পদ্মা সেতুর কিছুই হবে না।