২০১২ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) চারটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। ওই ঘটনায় নির্বাচন কমিশন মামলাও দায়ের করে। কিন্তু ওই চারটি ল্যাপটপ আজও উদ্ধার হয়নি। এ ঘটনায় কারা জড়িত—গত সাত বছরে তাও খুঁজে বের করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। আদালতে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনেও বিষয়টির তেমন গুরুত্ব ছিল না। ফলে পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেয়ে মামলাটিতে গ্রেফতার হওয়াদের খালাসের করে দেন আদালত।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই সময় আমি এখানে দায়িত্বে ছিলাম না। আমি যতদূর জানি, এ ঘটনায় চন্দনাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। পুলিশ এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের অধীনে চন্দনাইশে কর্মরত ৬-৭জনকে গ্রেফতার করে। পরে পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দোষী সাব্যস্ত না হওয়ায় তারা খালাস পায়।’
ল্যাপটপগুলা উদ্ধার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও ল্যাপটপগুলো উদ্ধার হয়নি।’ ওই ল্যাপটপগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত করে তিনি কোনও তথ্যও জানাতে পারেননি।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ল্যাপটপগুলো চুরি হয়ে যায়। ঘটনার দিন পিইআরআই প্রজেক্টের অধীনে কর্মরত আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ও প্রুফরিডাররা রাত ৮টা পর্যন্ত অফিসে কাজ করেন। অফিস সহায়কের কাছে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে তারা শহরে চলে আসে। পরে রাতে গ্রিল কেটে চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের দোতলার একটি কক্ষ থেকে চারটি ল্যাপটপ চুরি করে দুর্বৃত্তরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তৎকালীন চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই ডাটা এন্ট্রি করার পর বিকালে আমি শহরে চলে আসি। রাত ৮টা পর্যন্ত আউটসোর্সিংয়ের লোকজন অফিসে কাজ করে। এরপর সকালে গিয়ে আমরা গ্রিল কাটা এবং দরজার তালা ভাঙা দেখতে পাই। এ ঘটনায় প্রথমে আউটসোর্সিংয়ের লোকজনের ওপর আমাদের সন্দেহ হয়। পরে আমরা তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করি। পরে আমি বদলি হয়ে চলে আসি। ওই মামলা এখন কী অবস্থায়, আমার জানা নেই।’
ওই মামলার বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য দিতে পারেননি চন্দনাইশ থানার বর্তমান ওসি কেশব চক্রবর্তী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তখন আমি এখানে দায়িত্বে ছিলাম না। তবে যতদূর জানি, মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’ তদন্তে পুলিশ কারও সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি আর কোনও তথ্য দিতে পারেননি।
তবে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই মামলায় খালাস পাওয়া টেকনিক্যাল এক্সপার্ট নোমান শিবলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শহর থেকে গিয়ে ওই প্রজেক্টে কাজ করতাম। সারাদিন কাজ করার পর রাতে আবার শহরে ফিরে আসতাম। প্রতিদিনের মতো ওইদিন আমরা কাজ শেষ করে অফিস সহায়ককে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে শহরে চলে আসি। পরে সকালে জানতে পারি, অফিসের দ্বিতীয় তলার গ্রিল কেটে ও দরজার তালা ভেঙে ওই কক্ষ থেকে চারটি ল্যাপটপ চুরি হয়ে গেছে। সকালে আমরা চন্দনাইশে গেলে পুলিশ আমাদের থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে আমাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্তে আমাদের সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ। পরে পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করলে আদালত আমাদের খালাস দেন।’
মামলায় নোমান শিবলিসহ আরও ৪-৫ জন প্রুফরিডার ও হেলপারকে আসামি করা হয়। সবাই ওই মামলায় খালাস পেয়েছেন বলেও তিনি জানান।
নোমান শিবলি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় পুলিশ স্থানীয় কয়েকজন চোরকেও আটক করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা ল্যাপটপগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনও কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন। নোমানের দাবি, ‘যে কারণে পুলিশ এর কোনও হদিস খুঁজে বের করতে পারেনি।’
মামলায় ফাঁসানো হয়েছে অভিযোগ করে নোমান শিবলি বলেন, ‘চন্দনাইশে তখন কাজ করার সময় নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু অনিয়ম চোখে পড়ে। পরে এ ঘটনায় আমি পিইআরই প্রজেক্টের ডিরেক্টর বরাবর নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মচারীদের যোগসাজশে চন্দনাইশে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ এনে একটা লিখিত চিঠি দিয়েছিলাম। আমি ধারণা করছি, ওই কারণেই আমাকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
মিরসরাই থেকে হারানো ল্যাপটপেরও হদিস মেলেনি
২০১৫ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময় মিরসরাই থেকে একটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। ওই সময় হালনাগাদ করার জন্য মিরসরাই উপজেলা নির্বাচন অফিসে ডাটা এন্ট্রির জন্য জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে পাঁচটি ল্যাপটপ পাঠানো হয়। কাজ শেষে ২০১৬ সালে মিরসরাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় চারটি ল্যাপটপ বুঝিয়ে দেয়। ওই সময় তারা জানায়, আরেকটি ল্যাপটপ তারা পায়নি। তাদের কাছে চারটি ল্যাপটপ পাঠানো হয়েছে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই ল্যাপটপের আইডি ছিল ৪২১৪।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী (বর্তমানে রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) মাহফুজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মিরসরাই উপজেলায় পাঁচটি ল্যাপটপ পাঠিয়েছিলাম। কাজ শেষে ২০১৬ সালে তারা চারটি ল্যাপটপ পাঠিয়েছে। ওই সময় জানতে চাইলে মিরসরাই নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, তাদের চারটি ল্যাপটপ পাঠানো হয়েছে। ল্যাপটপ বুঝে পাওয়ার পর কেন এটি জানানো হয়নি, এ প্রশ্নের জবাবে তারা নিশ্চিত কিছু বলতে পারেনি।’
এ ব্যাপারে জানতে তৎকালীন মিরসরাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে কর্মরত তোফায়েল আহেমদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে, এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। আমাদের ঢাকা থেকে একটি টিম তদন্ত করছে। তদন্তে প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘মিরসরাই থেকে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটির আইডি কত ছিল, আমরা নিশ্চিত নই। পাসওয়ার্ড জানা থাকলে যে কেউ ল্যাপটপের আইডি পরিবর্তন করতে পারবেন।’