ইসলামী শরিয়তে পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু এটি কিছুতেই শর্তহীন নয়। বরং ভরণপোষণ, আবাসন ও শয্যাযাপনের ক্ষেত্রে শতভাগ সমতাবিধান নিশ্চিত করা না গেলে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী বা নারীদের ক্ষেত্রে এই অবকাশ রয়েছে যে তিনি আগের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইদ্দত শেষে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারবেন।
পুরুষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য এমন : ‘…তোমরা বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে—দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে (বিয়ে করো)…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩)
তবে একটি বিষয় এখানে পরিষ্কার হওয়া দরকার যে শর্ত সাপেক্ষে হলেও ইসলাম পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখার বৈধতা দিয়েছে। এই বৈধতার পেছনে কী কী হেকমত বা যুক্তি রয়েছে—এমন প্রশ্ন হরহামেশাই শোনা যায়। এখানে এর হেকমতগুলো বর্ণনা করা হলো—
১. একাধিক বিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এটি জানা কথা যে শুধু বিয়ের মাধ্যমেই সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় এবং একাধিক বিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বংশধরদের সংখ্যা একজন স্ত্রীকে বিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বংশধরদের সংখ্যার চেয়ে বেশি হবে।
আর বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে শক্তিশালী করা যায় এবং উম্মাহর কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়, যা তাদের অর্থনৈতিক মান উন্নয়ন করতে সক্ষম, যদি রাষ্ট্র মানবসম্পদের উন্নয়নে যথাযথভাবে কাজ করে। আর হ্যাঁ, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কখনো কখনো কিছু সংকট দেখা যায়। এটি মূলত রাষ্ট্রের অপব্যবস্থাপনার কারণে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন না থাকার কারণে। উদাহরণস্বরূপ চীনকে দেখুন। বাসিন্দাদের সংখ্যা অনুপাতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতি এবং এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং অন্য দেশগুলো চীনকে বিপর্যস্ত করার আগে কয়েকবার চিন্তা করতে বাধ্য। আর এটি বিরাট শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি। এর কারণ হলো, তারা তাদের জনসংখ্যার আধিক্য দেখে ভয় পায়নি, বরং মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২. গোটা বিশ্বের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারীদের সংখ্যা পুরুষদের সংখ্যার চেয়ে বেশি। যদি প্রত্যেক পুরুষ শুধু একজন নারীকে বিয়ে করে, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে কিছু নারীকে স্বামী ছাড়াই থাকতে হবে, যা তার ওপর এবং সমাজের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে। এটি তার জীবনকে সংকীর্ণ করার পাশাপাশি তাকে বিপথগামিতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। এবং এর মাধ্যমে সমাজে অনাচারের পথ প্রশস্ত হতে পারে।
৩. পুরুষরা এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়, যা তাদের জীবননাশের কারণ হয়ে থাকে, কারণ তারা সাধারণত বিপজ্জনক পেশায় কাজ করে থাকে। কখনো কখনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করে। এবং এতে নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি সংখ্যায় নিহত হয়ে থাকে। এটি হলো স্বামীবিহীন নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর তার একমাত্র সমাধান হলো একাধিক বিয়ে।
৪. পুরুষদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রবল শারীরিক চাহিদা বিদ্যমান, যাদের জন্য একজন স্ত্রী যথেষ্ট নয়। যদি এমন একজন ব্যক্তির জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাকে বলা হয় যে তোমার জন্য একাধিক স্ত্রী রাখা অনুমোদিত নয়, তাহলে এটি তার জন্য কঠিন কষ্টের কারণ হবে এবং তার জৈবিক চাহিদা তাকে হারাম পথে পরিচালিত করবে।
৫. একাধিক বিয়ের বিষয়টি ইসলামই প্রথম বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেনি। এর নজির বিশ্বে বহু আগে থেকে রয়েছে। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যেও প্রচলিত ছিল। আগের আসমানি কিতাবগুলোতে একাধিক বিয়ের কথা আছে। কয়েকজন নবী একাধিক নারী বিবাহ করেছিলেন। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর ৯০ জন স্ত্রী ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর সময় এমন কিছু ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যাঁদের আটজন অথবা পাঁচজন স্ত্রী ছিলেন। রাসুল (সা.) তাঁদের চারজন স্ত্রী রেখে বাকিদের তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
৬. একজন স্ত্রী হয়তো বন্ধ্যা হতে পারে অথবা হতে পারে অসুস্থ হওয়ার কারণে তার সঙ্গে তার স্বামী দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। অথচ একজন স্বামীর সন্তানের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, আর এর একমাত্র উপায় হলো অন্য একজন স্ত্রীকে বিয়ে করা।
৭. এমনটি হতে পারে যে একজন নারী একজন ব্যক্তির আত্মীয়া এবং তার দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই এবং সে একজন অবিবাহিত নারী অথবা একজন বিধবা নারী। ওই নারীর জন্য এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা যে তাকে প্রথম স্ত্রীর পাশাপাশি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া, যেন সে ওই নারীকে পবিত্র রাখতে পারে এবং তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। তাকে একাকী ছেড়ে দেওয়া এবং তার জন্য শুধু অর্থ ব্যয় করার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করার চেয়ে এ পন্থা অধিক উত্তম।
৮. ইসলামী শরিয়ত একটি শক্তিশালী সমাজকাঠামো দেখতে চায়। এ ক্ষেত্রে পরিবারগুলোর মধ্যকার বন্ধন শক্তিশালী হওয়া, অথবা কোনো নেতার সঙ্গে কিছুসংখ্যক লোক বা জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার বৃহত্তর স্বার্থ থাকতে পারে। যেমনটা দেখা যায়, মহানবী (সা.)-এর জীবনে। তাঁর কোনো কোনো বিয়ে ছিল এ ধরনের বৈরী লোকদের সঙ্গে বংশীয় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সন্ধি স্থাপনের নিমিত্তে। আর অন্যতম একটি উপায় হলো একাধিক বিয়ে করা।
৯. একজন নারীর প্রতি মাসে ঋতুস্রাব (হায়েজ) হয়, আর যখন তিনি সন্তান প্রসব করেন তখন তার ৪০ দিন পর্যন্ত রক্তপাত (নিফাস) হয়। সে সময় একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে পারে না। কেননা হায়েজ ও নিফাসের সময় সহবাস করা হারাম এবং এটি যে ক্ষতিকারক তা মেডিক্যালি প্রমাণিত। তাই ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হলে একাধিক বিবাহ করা অনুমোদিত।
নারী সব সময় এমন থাকে না যে স্বামী তার সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে পারে। প্রথম কারণ, প্রত্যেক নারীর জন্য মাসের কোনো এক সময় এমন অতিবাহিত হয় যখন তাকে পুরুষ থেকে দূরে থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, গর্ভকালীন অবস্থা। অর্থাৎ নারীকে নিজ ও নিজের সন্তানের স্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদে কয়েক মাস ধরে স্বামীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হয়। আবার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কয়েক মাস পর্যন্ত দূরে থাকতে হয়। এসব সময় নারীর জন্য কুদরতি প্রক্রিয়ায় স্বামীর সংস্পর্শ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে স্বামীর জন্য স্ত্রীর সংস্পর্শে যেতে কোনো বাধা-নিষেধ থাকে না। তখন যদি কোনো পুরুষের কামভাব চরমে পৌঁছে যায়, তাহলে একাধিক স্ত্রী ছাড়া তার জন্য কী-ই বা উপায় থাকে?
১০. প্রত্যেক দেশেই পুরুষের তুলনায় নারীদের শক্তি দ্রুত বার্ধক্যের শিকার হয়ে থাকে। যেখানে পুরুষের যৌবন পুরোপুরি অটুট থাকে এবং নারী বুড়ি হয়ে যায়, সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করা এত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, যেমন আগে প্রথম স্ত্রী বিবাহ করা আবশ্যক হয়েছিল।
যে আইন একাধিক স্ত্রী নিষিদ্ধ হওয়ার কথা বলে, প্রকারান্তরে সে আইন ওই সব পুরুষকে নিজ কামশক্তি ব্যভিচারের মাধ্যমে প্রয়োগের ইঙ্গিত করে, যাদের যৌনশক্তি সৌভাগ্যক্রমে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত অটুট থাকে। এমন আইন কিভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূলে হতে পারে?
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ…….