ধাপে ধাপে রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আরও সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনসহ সাংগঠনিক নানা বিষয়ে দেখভাল করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি টিম গঠন করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
দলটির স্থায়ী কমিটির নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ ডিসেম্বর রাতে করে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার দেশে ‘অজনপ্রিয়’ ও বিদেশে ‘বন্ধুহীন’ হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ক্যাসিনোসহ নানা দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।

এরই মধ্যে ছাত্রলীগের সভাপতি
ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনায় মন্ত্রী-এমপিরাও আছেন তোপের মুখে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুদেশের মধ্যকার চুক্তি ও সমঝোতা এবং বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে ছাত্রলীগ হত্যা করায় ঢাকাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দলটির নেতারা মনে করেন, এ অবস্থায় সরকার যে কোনো সময়ের চেয়ে ‘নাজুক’ অবস্থায় রয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ক্ষমতাসীন এ অবৈধ সরকারকে ভয় করার কিছু নেই। তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। তারা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। ধাক্কা দিলেই যে কোনো সময় পতন হবে।


গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেছেন নেতারা। স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকে আন্দোলন ছাড়াও ভারত প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। বিগত প্রায় চার বছর বিএনপি ভারত বিষয়ে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য দেয়নি। তারা বারবারই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার নানা চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তাতে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি বলে মনে করেন নেতারা। এ অবস্থায় নানা দিক বিশ্লেষণ করে বিএনপি তার আগের সিদ্ধান্তে ফিরে গেছে। দলটির নেতারা বলেছেন, দেশ ও দেশের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বিএনপি পথ চলবে। জনগণের দাবি উপেক্ষা করে মাঝখানে দেশবিরোধী চুক্তি অথবা সমঝোতা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকার করলেও বিএনপি চুপ ছিল। তারা মনে করে চুপ থাকাটা ছিল তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ।


সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরদিন গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে দুদেশের মধ্যকার চুক্তি-সমঝোতা প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা নিকট প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমতাভিত্তিক সুসস্পর্ক চাই; কিন্তু এই সরকার যা করছে তাতে দেওয়া-নেওয়ার বিষয় নেই; আছে শুধু দেওয়ার। দেশের স্বার্থ হানিকর এমন অসম চুক্তির অধিকার জনগণ সরকারকে দেয়নি। কাজেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের সময় স্বাক্ষরিত সব চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই এবং দেশের ও দেশের স্বার্থ হানিকর সব চুক্তি বাতিল চাই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আমাদের তো কথা বলতেই হবে। আমরা এদেশের জনগণের জন্য রাজনীতি করি। ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে কি কোনো অন্যায় করেছি? বিএনপি এদেশের জনগণের দল। দেশের জনগণের স্বার্থ আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবেÑ এটাই স্বাভাবিক।’
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া এক নেতা বলেছেন, চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি মাঠে না নামে, দল হিসেবে জনগণ বিএনপিকে ভুল বুঝবে। কারণ দেশের জনগণ যা চায়, তার সঙ্গে বিএনপির দৃশ্যমান কোনো কর্মকা- তারা দেখতে পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাগারে নিলেও মামলা-হামলার দোহাই দিয়ে বিএনপি ‘রহস্যজনক’ কারণে রাজপথে তেমন কোনো আন্দোলন-কর্মসূচি দেয়নি। চলমান পরিস্থিতিতেও যদি আমরা বসে থাকি তা হলে জনগণ সরকারের মতো বিএনপিকেও প্রত্যাখ্যান করবে।


অপর এক নেতা জানান, স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে নানা দিক আলোচনা শেষে ধাপে ধাপে আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে কোনো রকম বাধা দিলে পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। যদিও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল ও আবরার হত্যার প্রতিবাদে হরতাল কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছিলেন; কিন্তু স্থায়ী কমিটির অন্য নেতারা তার সঙ্গে দ্বিমত করেন। তারা বলেন, ভারতের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরদিনই হরতাল আহ্বান করলে ভালো হতো। এখন হরতালের সময় নয়। বরং জনসভায় বাধা দিলে প্রতিবাদে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকাটাই হবে যুক্তিযুক্ত।


আগের দিন রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত পরের দিন বৃহস্পতিবার জানান ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির এই নেতা ঘোষণা দেনÑ ভারতের সঙ্গে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল ও এই চুক্তির বিরোধিতার কারণে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে আজ শনিবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগর সদরে জনসমাবেশ, আগামীকাল রবিবার সব জেলা সদরে জনসমাবেশ করা হবে।
স্থায়ী কমিটির নেতাদের সূত্রে জানা যায়, এসব কর্মসূচি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তদারক করছেন। প্রতিটি জেলা ও মহানগরে এসব জনসভায় সিনিয়র নেতাদের অতিথি থাকতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে অতিথি তালিকা করে সংশ্লিষ্ট নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।


জানতে চাইলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের সময়কে বলেন, আজ শনিবার বেলা আড়াইটায় দলের নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসমাবেশ হবে। এতে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাসসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বক্তব্য রাখবেন।
আগামীকাল রবিবার নওগাঁর জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, আমরা দেশ ও দেশের জনগণের মনের ভাষা অনুযায়ী বিগত সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছি; এখনো নিচ্ছি। দেশের মানুষ চায় বিএনপি রাজপথে নামুক, সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিক। সেদিক বিবেচনায় আমরা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।


দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর করণীয় ঠিক করতে সারাদেশের প্রতিটি জেলা, মহানগরের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে স্কাইপের মাধ্যমে মতবিনিময় করেছেন তারেক রহমান। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সবার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আন্দোলনের বিষয়টি তোলা হয়। স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ নেতা আন্দোলনের পক্ষে মত দেন, যা সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়। আন্দোলনের বিষয়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
এদিকে বিগত সময়ে রাজপথে আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হতো; কিন্তু এবার সেই অবস্থা পাল্টে আন্দোলনের পাশাপাশি পুনর্গঠনকাজও চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী যুবদলকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও আগামী ১৪ অক্টোবরের পর যে কোনো দিন প্রকাশ করা হতে পারে।


বিএনপি সূত্রে জানা যায়, চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির দুই শরিক জোট ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার উভয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সন্ধ্যায় ২০-দলীয় জোটের বৈঠক হয় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। এতে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান। এই সভায় ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল ও আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ঘোষিত বিএনপির আজ শনিবার ও কাল রবিবারের বিভাগ ও জেলা সদরের জনসভায় সংহতি জানাবে ২০-দলীয় জোট। পাশাপাশি ২০-দলীয় জোট আগামী ১৫ অক্টোবর আবরারের স্মরণে সভা করার সিদ্ধান্ত হয়। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ঐক্যফ্রন্ট বৈঠক করে মতিঝিলে গণফোরাম কার্যালয়ে। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অংশ নেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শোক র‌্যালি করবে আগামীকাল রবিবার। এতে বিএনপি নেতারাও অংশ নেবেন।