দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর বিএনপির কাউন্সিল করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করতে হবে। ২০১৬ সালে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়। নিয়মানুযায়ী এ বছর জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু কাউন্সিল করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত দলের সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে নতুন করে ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন মাসের জন্য করা এ আহ্বায়ক কমিটির ১২টির মেয়াদও পার হয়েছে। একই অবস্থা অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনেরও। জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল ও তাঁতি দলের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে। এই অবস্থায় পুনর্গঠন কাজ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না বলে বিএনপি নেতারা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়। সে অনুযায়ী চলতি বছর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে এবং দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় চলতি বছর কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা গেলে নতুন বছর অর্থাৎ আগামী বছরে ছোট পরিসরে হলেও খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে কাউন্সিল হতে পারে বলে বিএনপি নেতারা আভাস দিয়েছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ভোটের মাধ্যমে সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সর্বত্র ভোটের মাধ্যমে সব কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে কমিটি গঠনের কাজ চলছে।

কাউন্সিল বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ভিত্তিহীন মামলায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সরকারের বাধায় তিনি দেশে আসতে পারছেন না। নেত্রীকে মুক্ত করেই বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে কাউন্সিল করতে চাই।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৬ বছর ধরে বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি কারাগারে। তার অনুপস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাল ধরেন। এর মধ্যে ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির মধ্যে ১৯টির আহ্বায়ক কমিটি এবং ৯টির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও ১৯টির মধ্যে ১২টিরই মেয়াদ পার হয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

সূত্র মতে, নীলফামারী জেলার আহ্বায়ক কমিটি হয় চলতি বছরের ১৮ মার্চ, হবিগঞ্জে ২৪ এপ্রিল, মানিকগঞ্জে ১ মে, নওগাঁ ও যশোরে ৮ মে, বগুড়ায় ১৫ মে, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে ১৯ জুন, সৈয়দপুরে ২৮ জুন, পাবনা, নাটোর ও রাজশাহীতে ৪ জুলাই। বাকি কমিটির কার্যক্রমও সুবিধাজনক নয়। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলা কমিটির মেয়াদ বহু আগে পার হলেও আহ্বায়ক কমিটিই করতে পারছে না কেন্দ্র। প্রভাবশালী নেতাদের চাপে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বারবারই ব্যর্থ হচ্ছেন। একই অবস্থা ময়মনসিংহ বিভাগে। দিনাজপুরে আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ বহু আগে শেষ হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ও ফরিদপুরে কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত আহ্বায়ক কমিটি করতে পারেনি দলের হাইকমান্ড।

অঙ্গসংগঠনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, তাঁতি দল, মৎস্যজীবী দলের নতুন আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ পার করেছে। তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করতে ২০ বছর পর চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি কৃষক দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মৎস্যজীবী দল ও ৬ এপ্রিল তাঁতি দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটি ঘোষণার সময় বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার সময় বলা হয় আগামী তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিল করে কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে হবে।

দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতা বলেন, যেখানে আছে, সবাই নিজের লোককে পদে বসাতে চান। এসব কারণেই কোনো কমিটি ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। ছাত্রদল ও ড্যাবের কমিটি গঠন ছাড়া কোনো কমিটিকেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি দল।

যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের মেয়াদ চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে। এই অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও এসব সংগঠনের নেতাদের ‘ভেজা চোখের’ অনুরোধে আংশিক পাঁচ সদস্যের কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করার অনুমতি দিয়েছেন। যুবদলকে ২০ অক্টোবর ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে উভয় সংগঠনের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলেও তিন মাস পর কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের চাপের পাশাপাশি যুবদলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতার পদ ভাগাভাগিতে তাও সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে এরই মধ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, যেভাবে দল চলছে তাতে করে পুনর্গঠন কাজ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নেতাদের মধ্যে দলাদলি দেখে দলের হাইকমান্ড ভোটের মাধ্যমে প্রতিটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দিলেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাউন্সিল করতেই গড়িমসি করছেন। বিএনপির জেলা, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন করতে যেখানে বেগ পেতে হচ্ছে সেখানে জাতীয় কাউন্সিল করার প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপি এর আগের কাউন্সিলও তো ঠিক সময়ে হয়নি।

বিএনপির প্রথম কাউন্সিল ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তৃতীয় ১৯৮৯ সালের মার্চে, চতুর্থ ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে, পঞ্চম ২০০৯ সালের ডিসেম্বর, সর্বশেষ ষষ্ঠ কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, এত তাড়াহুড়া কীসের? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ এক বছর অপেক্ষা করে, কিছু করেনি। কিন্তু এবার বিএনপি তো পরাজিত হয়নি, কারসাজি এবং জোর করে হারানো হয়েছে।

জাতীয় কাউন্সিল না হলেও চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির শূন্যপদ পূরণে উদ্যোগ নিতে পারেন তারেক রহমান। এই নিয়ে দলের মধ্যে বেশ আলোচনাও আছে। এরই মধ্যে স্থায়ী কমিটিতে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই শূন্যপদ খুব শিগগির পূরণ করতে হবে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে সক্রিয় মাত্র আটজন। শূন্যপদই আছে তিনটি। ভাইস চেয়ারম্যান পদও বেশ কয়েকটি শূন্য। আবার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক নেতার এক পদ বাস্তবায়ন করা হলে আরও বেশ কিছু পদ শূন্য হবে। দলের পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের সময়কে বলেন, সব কিছুই দলের হাইকমান্ডের নজরে রয়েছে। যেহেতু দেশে রাজনীতি নেই, তাই সময়-সুযোগ অনুযায়ী প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।