২০১৭ সালের নভেম্বরে দীপক আগারওয়াল জুয়ার ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন তারকা ওপেনার তামিম ইকবালকেও। কিন্তু তাৎক্ষণিক তিনি বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করায় বিপাকে পড়তে হয়নি তাঁকে।
দীপক আগারওয়াল। দিল্লির চিহ্নিত ক্রিকেট জুয়াড়ি। আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটে (আকসু) এই ভারতীয়র ইতিবৃত্ত সংরক্ষিত আছে। সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় বাংলাদেশে উচ্চারিত এ নামটি অবশ্য জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কাছে নতুন নয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে দীপক আগারওয়াল জুয়ার ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন তারকা ওপেনার তামিম ইকবালকেও। কিন্তু তাৎক্ষণিক তিনি বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করায় বিপাকে পড়তে হয়নি তাঁকে।
গতকাল আইসিসি প্রেরিত সাকিবের আমলনামায় সংযুক্ত তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের যে বিশাল ফিরিস্তি দেওয়া আছে, সেখানেও দীপক আগারওয়ালের নাম রয়েছে। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তাকে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে সাকিব জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের নভেম্বরে পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে তাঁর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন দীপক আগারওয়াল। এটা তিনি জানতেন। এবং এটাও জানতেন যে তাঁর পরিচিত ব্যক্তির (নাম উল্লেখ করা হয়নি) কাছ থেকে বিপিএলে অংশগ্রহণকারী আরো অনেক ক্রিকেটারের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন দীপক।
সেবার বিপিএল অনুষ্ঠিত হয়েছিল নভেম্বর মাসে। তবে কি সাকিবের পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকেই তামিম এবং আরো কয়েক ক্রিকেটারের নম্বর জোগাড় করেছিলেন দীপক? সেসব প্রশ্নের উত্তর নেই আইসিসি প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। তবে বিপিএলের মাঝপথে ঢাকায় উপস্থিত আকসুর কর্মকর্তাদের দরবারে তামিমকে হাজির হতে হয়েছিল।
বিসিবির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, সেদিন ঢাকার একটি হোটেলে আকসুর অস্থায়ী ‘কাঠগড়া’য় তামিম ছাড়াও ডাকা হয়েছিল আরো ছয় বাংলাদেশি ক্রিকেটারকে। ‘সেখানে ঢুকে কিছুটা হকচকিত হয়ে যান তামিম। আকসুর নারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় দীপক আগারওয়ালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের বিষয়টি। তবে আগেই বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তা মেজর মোর্শেদকে জানিয়ে রাখায় তামিমের কোনো সমস্যা হয়নি’, গতকাল জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।
তবে এতেই নাকি সন্তুষ্ট হননি আকসুর দুই প্রতিনিধি। তাঁরা তামিমের কললিস্ট পরীক্ষা করেন। সেখানে দীপকের নম্বর যথারীতি পাননি। কারণ দীপক জুয়াড়ি সন্দেহ হতেই নম্বরটি ব্লক করে দিয়েছিলেন তামিম। পরে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ থেকে দীপকের সঙ্গে খুদেবার্তার রেকর্ড অবশ্য তামিমই দেখিয়েছেন আকসুর কর্মকর্তাদের। অবশ্য এর স্ক্রিনশট আগেই বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের মেজর (অব.) মোর্শেদকে পাঠিয়েছিলেন তামিম।
সেসব টেক্সট পাঠ করেছেন এমন একজন কর্মকর্তা গতকাল জানিয়েছেন তামিমের সঙ্গে দীপকের খুদেবার্তায় আলাপের সারসংক্ষেপও, ‘এরা শুরুতে সাধারণ ভক্ত পরিচয়ে কিংবা কারো রেফারেন্সে আলাপ শুরু করে। দীপক ফ্যান হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। বলেছিল, দেখা করতে চায়। তামিমের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়া একসময় সে (দীপক) ডেসপারেটলি প্রস্তাব দেয়—এবার তো টিভিতে খেলা (বিপিএল) দেখাবে। টাইম টু মেক সাম মানি।’
এ বার্তা পাওয়ার পরপরই মোর্শেদকে বিষয়টি অবহিত করেন তামিম। বেঁচে যান তিনি। ‘এটাই নিয়ম। আইসিসি ইভেন্ট তো বটেই, দ্বিপক্ষীয় সিরিজের আগেও অংশগ্রহণকারী ক্রিকেটারদের খেলা শুরুর আগেই বিশেষ সভায় ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হয় জুয়াড়িদের ব্যাপারে। ছবি দেখানো হয়, গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা চিহ্নিত জুয়াড়িদের গতিবিধি এবং ফোন নম্বরের পাশাপাশি সম্ভাব্য কোন উপায় এবং কী ভাষায় জুয়াড়িরা ক্রিকেটারের মনে ঘর বাঁধতে চায়, এর বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সেসব সভায় অংশ নিয়ে অভ্যস্ত একজন ক্রিকেটার গতকাল বলছিলেন, ‘কথাগুলো এতবার শুনেছি যে মুখস্থ বলে দিতে পারব!’
সাকিব আল হাসান অবশ্য নিজেও সে দলেই পড়েন। আকসুর জিজ্ঞাসাবাদে তিনিও বলেছেন, জুয়াড়ির সংশ্রবে এলে বিষয়টি আকসুকে জানানো বাধ্যতামূলক। না জানালে শাস্তির বিষয়টিতেও অবগত তিনি।
এর পরও আকসুর রাডারে ধরা পড়া দীপক আগারওয়ালের সঙ্গে তিন দফা যোগাযোগের বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাননি সাকিব আল হাসান। অথচ কিছু খুদেবার্তা পেয়েই তামিম বুঝে ফেলেন দীপক আগারওয়াল জুয়াড়ি। আর জুয়াড়ি হিসেবে কাউকে সন্দেহ হলেই সেটি আকসুকে অবহিত করার নিয়ম। সে নিয়ম মেনে ২০১৭ নভেম্বরের আগেও আকসুর কাছে আরেক ভারতীয় সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন তামিম। ২০০৮ সালের ওই ঘটনায় তামিমের সঙ্গে সঞ্জয়ের ব্যাপারে আকসুকে অবহিত করেছিলেন সাকিবও, যা ২০১০ সালে লর্ডস টেস্ট শুরম্নর আগে আচমকাই মিডিয়াকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। অথচ ওই ঘটনার প্রায় ৯ বছর পর আরো পরিণত সাকিব জুয়াড়ির সঙ্গে তিন দফা যোগাযোগের বিষয়টি অবহিত করার বিষয়টিকে গুরুত্বই দিলেন না!
অধিনায়কের এমন অজ্ঞতায় বিস্মিত অনেক ক্রিকেটারই। তবে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউই। এ ব্যাপারে তামিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ‘দীপক আগারওয়াল তো…’, এটুকু শুনেই গতকাল সন্ধ্যায় ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি। এরপর খুদেবার্তা পাঠিয়েও তামিমের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সাকিবের দীর্ঘদিনের সতীর্থদের সবারই ‘ফুটওয়ার্ক’ অভিন্ন—প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগ।
কালের কণ্ঠ অনলাইন