হলদে আলো ঠিকরে পড়ছিল রেড কার্পেটে। সেই আলোতে একজন করে মডেল কিংবা ডিজাইনার পা রাখছেন আর হুট করেই যেন কিছুটা বদলে যাচ্ছিলেন। মুহূর্তেই ভিন্ন রঙের আলো ছিটকে আসছে, তখন আরেক রূপ ফুটে উঠছে তাঁদের। সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়েছে। আকাশে যদিও কিছুটা আলোর আভা ছড়িয়ে ছিল, সে আলোও আড়াল হয়ে গিয়েছিল রং বেরঙের পোশাক পরে আসা মডেলদের আলোতে। রাজদর্শন হলে প্রবেশের মুখেই আমন্ত্রণপত্রে চিহ্ন দিয়ে দিচ্ছিলেন দ্বাররক্ষী ও আয়োজকেরা।

প্রবেশপথের কার্য সম্পন্ন করলেই রেড কার্পেট। আগত অতিথি, মডেল ও ডিজাইনাররা রেড কার্পেটে পা দিয়েই ভেতরে চলে যাচ্ছেন। ভেতরে বলতে হলঘরে নয়, বাইরে কফি স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেউ কেউ রেড কার্পেট পেরিয়ে ছবি তোলার পর্ব সম্পন্ন করে হলের সামনের জায়গায় স্ন্যাকস ও কফি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন। চলছে আড্ডা। এসব আড্ডাতে একটু মনোযোগ দিতেই বোঝা গেল অধিকাংশই ডিজাইনার। কেউ কেউ এদেশীয়, কেউ কেউ এসেছেন ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে হেসে উঠছেন। কথা বলছেন পোশাক নিয়ে, নকশা নিয়ে, ফেব্রিকস নিয়ে।

ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২০ গতকাল ছিল শেষদিন। এদিন ডিজাইনার ও মডেলদের উপস্থিতি মুখর হয়ে উঠেছিল বসুন্ধরার রাজদর্শন হল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার একটু পরেই হলের গেট খুলে দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে র‍্যাম্পের রানওয়ের দুইপাশের চেয়ার ভরে উঠল। কেউ কেউ চাইছিলেন একটু সামনে বসতে একটু নিকট থেকে মডেলদের দেখতে। 

রানওয়ে অফ লাইফ, ডু ইট ফর ইউ স্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের গতকাল শনিবার ছিল শেষদিন। স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর প্রাণোচ্ছ্বল ছিল পুরো আয়োজন। শেষদিনে বাংলাদেশের লিপি খন্দকার, খুকু, চন্দনা দেওয়ান, সারাহ করিম, রিফাত রেজা রাকা, ফারাহ দিবা, ফাইজা আহমেদ, ভারতের আসিফ শেখ ও অলকা শর্মা এবং ভুটানের চন্দ্রিকা তামাং এর ডিজাইনের পোশাক পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা।

এদিনও স্ক্রিনে ভেসে ওঠেন আফসানা মিমি, ‘বললেন তুমি সুন্দর হে নারী…’ ধীরে ধীরে রানওয়ের ওপর আলো প্রক্ষেপিত হতে থাকে আর একটু একটু করে আলোর নিচে ভেসে ওঠেন সুনেরা বিনতে কামাল। একে কে জেফার,  হৃদি শেখ নাবিলারা। আফসানা মিমি প্রত্যেককেই উপমিত করেন। কাউকে জলের সাথে, কাউকে মেঘের সাথে, প্রজাপতির সাথে..। এরপর পেছনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আস্ত সমুদ্র। তীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। সেই ঢেউয়ের সাথে খলবলিয়ে উঠছেন নাবিলারা-আর তখন এটাকে র‍্যাম্পের রানওয়ে মনে হচ্ছিল না বরং মনে হচ্ছিল সত্যিই একটা সমুদ্রতীর, যেখানে কতগুলো বালিকা হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।

ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক বাংলাদেশের শেষদিনেও ডিজাইনারদের পোশাকে দেশীয় ঐতিহ্য প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল৷ প্রথমেই লিপি খন্দকারের পোশাকে রান ওয়ে প্রদক্ষিণ করেন মডেলরা। এই ডিজাইনারের পোশাকে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটে ওঠে। প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন কুহু। কুহুর পোশাকে ফুটে ওঠে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখচ্ছবি, অজগর, ময়ূরের পাখা। অবশ্য আগেই উপস্থাপক প্রমি জানিয়ে দিয়েছিলেন কুহুর ডিজাইন করা পোশাক পরিবেশ রক্ষার বার্তা দেয়। কুহু নিজেও র‍্যাম্পে দুই শিশুর হাত ধরে র‍্যাম্পে আসেন। তাদের হাতে ছিল প্রাণীরক্ষার আবেদন সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। বাংলাদেশের পরিচিত আরেক ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ান। এই ডিজাইনার মূলত কাজ করেন দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে। সূতি কাপড়ে সংস্কৃতি ও ‌উৎসবের ছবি ওঠে ফুটে ওঠে চন্দনার ডিজাইনে। র‍্যাম্পেও অবশ্য প্রশংসার করতালিতে সেই আবহ তৈরি করতে সক্ষম হন চন্দনা।

ভারতের তরুণ ডিজাইনার অলকা শর্মার পোশাক মুঘল সাম্রাজ্যকে তুলে ধরে দর্শকদের সামনে। র‍্যাম্প মডেলরা প্রথমে মুঘলের ঐতিহ্য তুলে ধরেন নিজেদের পরিহিত পোশাকে। সূতি খাদির পোশাকে কাজ করতে অভ্যস্ত অলকা মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের আভিজাত্য, ঐতিহ্য ও মৌসুমী পোশাক ডিজাইনে বিশেষ পারদর্শী। রানওয়ে ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে একরাশ মুগ্ধতা রেখে যান ভারতের এই ডিজাইনার। অলকা শর্মার পরেই বাংলাদেশের সারাহ করিমের ডিজাইন করা পোশাকের প্রদর্শন করেন মডেলরা। জামদানি নিয়ে কাজ করা সারাহ করিমের পোশাকের ডিজাইনে মুগ্ধতা প্রকাশ করতে দেখা যায় বিদেশি অতিথিদের। এরপরেই রিফাত রেজা রাকার পোশাক পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা। রাকা মসলিন ও সুতি নিয়ে কাজ করেন। তাঁর পোশাকে উৎসব ও দেশীয় ঐতিহ্য ফুটে ওঠে।

ভুটানের ডিজাইনার চন্দ্রিকা তামাং তাঁদের চিরাচরিত ঐতিহ্যের পোশাক নিয়ে অবশ্য আসেননি। ফ্যাশন সচেতন সম সাময়িক জীবনযাত্রার জন্য প্রযোজ্য এমনসব পোশাকই রানওয়েতে প্রদর্শন করেন চন্দ্রিকা। তবে বাংলাদেশি প্রশংসা আদায় করেন ভুটানের ডিজাইনার।

বাংলাদেশি ডিজাইনার ফারাহ দিবা মূলত খাদি নিয়ে কাজ করেন। তার পোশাকে মৌসুমী ফ্যাশন আধিপত্য পায়। ফাইজা আহমেদের ডিজাইনে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। লিনেন ও সুতির ওপর দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন দর্শকরা পছন্দ করেন বেশ। শনিবার সর্বশেষ ডিজাইনার ছিলেন ভারতের আসিফ শেখ। মেটাল, প্রিন্টেড, এমব্রয়ডারি নিয়ে কাজ করেন। রানওয়েতে ছড়িয়ে দেওয়া ধোঁয়ার ভেতর শ্বেত শুভ্র পোশাকে একে একে হেঁটে আসেন মডেলরা। ভারতের এই তরুণের ডিজাইন করা পোশাক প্রদর্শনীর মাধ্যমেই পর্দা নামে ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২০। পুরো হল তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে তিন দিনব্যাপী এই ফ্যাশন উইকের সমাপনী জানায় দর্শকেরা। এবারের ফ্যাশন উইকের বিশেষত্ব ছিল র‍্যাম্পে শুধু মডেলরাই হেঁটেছেন তা নয়,  হেঁটেছেন সংগীত শিল্পী, ক্রিকেটার, পাইলট, ডাক্তার, ফুটবলার।