কয়েক বছরের প্রথা অনুসারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকা মেলার প্রথম বেলা শিশু প্রহর। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে মেলা এখন জমজমাট। ছুটির দিনে এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হলো পহেলা ফাল্গুন। আর প্রথমবারের মতো মিলন ঘটেছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। সব মিলিয়ে গতকাল শুক্রবার বইমেলার দিনটি ছিল বহুত্বের সম্মিলনে বর্ণিল।

মেলায় বসন্তের ছোঁয়া লাগে সকাল থেকেই। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে বাসন্তী শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা মা-বাবার উপস্থিতি ছিল শুরু থেকেই। বেলা যত গড়িয়েছে, মাথায় রঙিন ফুল গুঁজে নারী-তরুণী দলের উপস্থিতি বেড়েছে। অগণিত পাঠক-দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে মুখর হয়ে ওঠে বিশাল মেলা প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত একই টইটম্বুর পরিবেশ। ফলে গতকাল মেলায় প্রথম দেখা মিলল ধুলোর। তবে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মুখর মেলা প্রাঙ্গণের কোথাও কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। অবশ্য ভিড়ের চাপে শিশু হারানোর ঘটনা ঘটেছে একাধিক। একদিকে শাহবাগ মোড়, অন্যদিকে হাইকোর্ট চত্বর থেকে মানুষ আসছিল বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। কখনো পরিবারসহ, কখনো জুটি বেঁধে, কখনো বা দল বেঁধে। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশপথে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ লাইন।

বিশেষ এই দিনে ভক্ত-পাঠকদের সঙ্গ দিতে কবি-সাহিত্যিকদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে দেখা গেল ভক্তদের কেনা বইয়ে অবিরাম অটোগ্রাফ দিতে। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, তিনটি উৎসব একসঙ্গে যোগ হওয়ায় মেলাটা আজ পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। অপূর্ব সুন্দর লাগছে—ছেলে-মেয়েরা হলুদ-লাল পোশাক পরে এসেছে। মেয়েরা খোঁপায় ফুল দিয়েছে।

জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হককে দেখা গেল প্রথমার স্টলে। মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালকে দেখা গেল বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ছিলেন পার্ল পাবলিকেশন্সের স্টলে। নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়ার পাশাপাশি ভক্ত-পাঠকের অনুরোধে সেলফিবন্দি হতে তাঁকে স্টলের বাইরে এসে হাসিমুখে দাঁড়াতে দেখা গেছে। গোটা মেলা প্রাঙ্গণ জুড়েই মুখর আড্ডায় দেখা গেল অনেক কবি-সাহিত্যিককে।

এই ভিড়ে প্রকাশকদের মুখেও হাসি ফুটেছে। বেচাবিক্রি এ যাবৎকালের সর্বাধিক—জানালেন ম্যাগনাম ওপাসের আনোয়ার ফরিদী। বই প্রকাশের চাপে মহাব্যস্ত প্রকাশকদেরও দেখা গেছে স্টলে স্টলে।

সকালে শিশু প্রহরে যারা এসেছিল, কিংবা ভিড়ের চাপে হারিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে যে শিশুরা, এবারের মেলায় তাদের জন্য প্রকাশকদের কী আয়োজন—সে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি আমরা।

জানা গেল জনপ্রিয় লেখকরা এবারও শিশুদের জন্য অল্পবিস্তর হলেও লিখেছেন।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘ছোট একটা নেংটি ইঁদুর’ প্রকাশ করেছে অনুপম প্রকাশনী। গল্প ‘মিতু তিতুর সাবমেরিন’ এনেছে বিদ্যাপ্রকাশ। এ লেখকের ‘যে রকম টুনাটুনি সে রকম ছোটাচ্চু’ প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স।

হায়াৎ মামুদের ‘যাদুকরের ভেঁপু’ অবসর এবং আনোয়ারা সৈয়দ হকের গল্পের বই ‘ছানার নানাবাড়ি’ ঐতিহ্য প্রকাশ করার কথা।

ইমদাদুল হক মিলনের শিশুতোষ সিরিজ ‘বাবান’ প্রকাশ করেছে অনন্যা। আনিসুল হকের কমিকস ‘গুড্ডুবুড়া’ প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। তাঁর গল্প ‘ডাকাতের কবলে গুড্ডুবুড়া’ এসেছে প্রথমায়। প্রথমায় আরো আসবে ‘গুড্ডুবুড়া যেভাবে ঢাকাকে বাঁচিয়েছিল’ বইটি।

ধ্রুব এষের গল্পের বই ‘অং বং চং’ প্রকাশ করেছে ইকরি মিকরি। ‘তনু ও ছয় দফার খাতা’ প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। আলম তালুকদারের ‘রূপকথার আজবকথা’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। কথা প্রকাশ এনেছে মুস্তাফিজ শফির ‘মাথাকাটা ভূতবাহিনী’। জাহীদ রেজা নূর অনূদিত রূপকথা ‘ফিনল্যারে রূপকথা’ প্রকাশ করেছে শিশু গ্রন্থ কুটির।

শিশু চত্বরে কথা হয় খিলগাঁও তালতলা থেকে আসা চাকরিজীবী আরিফুর রহমান ও আলেয়া নাসরিন দম্পতির সঙ্গে। দুই সন্তান সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছেন তাঁরা। শিশুদের জন্য ভালো মানের বই পাওয়া যায় না বলে অনুযোগ করেন তাঁরা। তাঁদের প্রশ্ন—বড় লেখকরা কেন যে লেখেন না। দাম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।

মেলা ঘুরে বড় লেখকদের খুব বেশি শিশুতোষ বই পাওয়া গেল না। প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিশুদের বইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বড় লেখকদের এ বিষয়ে মনোযোগ একটু কম। আবার অনেকে এ বিষয়ে বই প্রকাশ করলেও সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। কালি ও কলম প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়ে তরুণ লেখকদের পুরস্কৃত করে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর শিশুতোষ বিষয়ে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি—মানসম্পন্ন বই না পাওয়ায়।

তাহলে মেলায় শিশুদের হাতে এত যে বই, সেগুলো কী? শিশু চত্বরের ঝিঙেফুলের বিক্রয়কর্মী জানালেন, বিভিন্ন দেশের রূপকথার বই, ঠাকুরমার ঝুলি, ধাঁধার বই, ঈশপের গল্প, গোপাল ভাঁড়, কমিক্স, রম্যগল্প, চিরায়ত সাহিত্যের বই-ই বেশি চলে। মনোলোভা প্রচ্ছদ, ভালো কাগজ, উন্নত বাঁধাই এবং আকর্ষণীয় অলংকরণ হলে একটি বই চলে যায়।

মেলায় আসা শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে চারটি নির্বাচিত বইয়ের তথ্য তুলে ধরা হলো।

‘বাবান’ : ‘বাবান এক অদ্ভুত শিশু। একদিন হঠাৎ সে টুনটুনি পাখির ভাষা বুঝে গেল। তাদের গুলশানের বাড়ির পেছন দিককার বাগানে, হাসনুহেনা ঝোপে টুনটুনি পাখি বাসা বেঁধেছে। তিনটি ডিম দিয়েছে। দেখে বাবান তার মাকে বলল, বাচ্চা হবে দুটো। দেখা গেল ঠিকই দুটো বাচ্চা হয়েছে।’ এ রকম গল্পের শিশুতোষ সিরিজ বাবান লিখেছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। সিরিজের তিনটি বই—‘বাবান ও টুনটুনি পাখি’, ‘বাবান ও তার বিড়ালছানা’, ‘বাবান ও দশটি কাক’। প্রকাশ করেছে অনন্যা। প্রতিটি বইয়ের মূল্য ১৩৫।

‘মিতু তিতুর সাবমেরিন’ : তিতু আর মিতু দুই ভাই-বোন। তাদের কাজের শেষ নেই। যখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছে, ঘরের বাইরে যেতে পারছে না, তখনো তারা বসে নেই। কাউকে না জানিয়ে দুই ভাই-বোন নিজেদের সাবমেরিনে করে চলে যায় সমুদ্রের নিচে। এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লিখেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। চমৎকার ছবি এঁকেছেন নাসরীন সুলতানা মিতু। বইটি প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ।

‘ডাকাতের কবলে গুড্ডুবুড়া’: কথাশিল্পী আনিসুল হকের চমৎকার এক চরিত্র গুড্ডুবুড়া। মজার মজার কাণ্ড ঘটায় সে। বাসায় ঢুকে পড়েছে ডাকাত। হাতে পিস্তল। গুড্ডুবুড়া একা। এখন কী হবে? এ রকম গল্প নিয়ে বইটি। প্রকাশ করেছে প্রথমা। মূল্যা ১০০ টাকা।

‘অং বং চং’: শিশুতোষ গল্পের বই। গল্পগুলো লিখেছেন জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী ও লেখক ধ্রুব এষ। বইয়ের ছবি এঁকেছেন সারা টিউন। নতুন পড়ুয়া শিশুদের জন্য অল্প কথামালার আকর্ষণীয় অলংকরণের এ বইটি প্রকাশ করেছে ইকরি মিকরি। মূল্য ১৩০ টাকা।

গতকালের অনুষ্ঠানমালা : গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৩৬৯টি। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আসাদ চৌধুরী রচিত ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শোয়াইব জিবরান। আলোচনায় অংশ নেন আনিসুর রহমান ও নূরুন্নাহার মুক্তা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খুরশীদা বেগম।