মোঃ রোমান- ফরিদপুর প্রতিনিধি
প্রশাসনের করোনা বিরোধী সচেতনতা অব্যাহত থাকায় পুরো ফরিদপুর জেলা এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে পরিণত হয়েছে। এদিকে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষা নিশ্চিত করনার্থে তাদের জন্য ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পিপিই প্রদান করা হয়েছে। শুধু পিপিই নয়, তাদের যাতায়াত সমস্যা সমাধানে জেলার সকল উপজেলায় মাইক্রোবাসের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের করোনা ভাইরাস বিরোধী সচেতনতা অব্যাহত থাকায় এখন কার্যত পুরো ফরিদপুর জেলা হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে। অতীব প্রয়োজন ব্যাতিত কাউকে বাইরে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা ঘাটসহ অধিক জনসমাগমস্থল পূর্ন ফাকা। এদিকে চিকিৎসকসহ সংশ্লিদের করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পিপিই প্রদান করা হয়েছে। একই সাথে জেলার ৯ টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের জন্য মাইক্রোবাস রিকুইজিশন করে দেয়া হয়েছে।
গত ২৬ তারিখ থেকে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সমস্যায় পড়ে চিকিৎসা পেশার সাথে বিশেষত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কাজের জন্য যে সকল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীবৃন্দ। তাদের উপযুক্ত যানবাহন না থাকায় যাতায়াত করতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন যাতায়াতের বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো মাত্রই জেলা প্রশাসন থেকে সকল উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের জন্য মাইক্রোবাস রিকুইজিশন করা হয়।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জানিয়েছেন, সম্ভাব্য করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে অথবা সর্দি কাশি ও জ্বর নিয়ে যে সমস্ত রোগী হাসপাতালে আসছেন, চিকিৎসক ও নার্সরা যাতে নির্ভয়ে তাদের শুশ্রুষা করতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় পিপিইরও সংস্থান করা হয়েছে। সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় এবং প্রাণিসম্পদ বিভাগের নিকট হতে প্রাপ্ত পিপিইসমূহ জেলা এবং উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে সরবরাহ করা হয়েছে এবং আরো বেশ কিছু পিপিই মজুদ রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এটুআই হতে আরও পাঁচশত সেট পিপিই ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা: মো: ছিদ্দিকুর রহমান ফরিদপুরে পিপিই সম্পর্কে বলেন, এই মুহূর্তে পিপিই নিয়ে কোনো সংকট নেই। চিকিৎসকগণ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত রয়েছেন। জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় আমরা কমিউনিটি সেন্টারের ডাক্তারদের জন্যও পিপিইর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ফরিদপুরে করোনা ভাইরাস বিরোধী কাযক্রম অব্যাহত রয়েছে। জেলার সালথা উপজেলাস্থ ৫০ শয্যা বিশিষ্ট নবনির্মিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউসহ ১০ শয্যা বিশিষ্ট একটি ইউনিটকে কোয়ারেন্টাইন হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভাঙ্গা উপজেলাধীন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটকেও আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ এ জেলার ০৯ টি উপজেলাতেই উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত কন্ট্রোলরুম চলমান রয়েছে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সমগ্র জেলায় (শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত) মাইকিং এবং সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ, এনজিও, মসজিদের ইমাম এবং সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেও জনগণের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত কন্ট্রোলরুমের হটলাইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সকল সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক ডেক্স খোলা হয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তার, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, সাপোর্ট স্টাফদের সমন্বয়ে জেলা পর্যায়ে ১৪ সদস্যের এবং উপজেলা পর্যায়ে ০৭ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ০৮ সদস্য বিশিষ্ট র্যাপিড রেসপন্স মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফরিদপুর জেলায় করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা ও উপদেশ প্রদান এবং স্থানীয় জেলা কমিটির সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য অভিজ্ঞ ০৭ জন ডাক্তারের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে এ জেলার সকল ইউনিয়নে ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং জেলা ও উপজেলা কমিটি সময়ে সময়ে সভা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণসহ সকল মানুষকে তাদের নিজ নিজ বাসা/বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ এবং বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে জেলা ব্যাপী বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে নিয়মিত সচেতনতামূলক মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। বিরাজমান নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় জনসমাগম পরিহারের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন কর্তৃক গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সাপ্তাহিক সকল হাট (পশুর হাটসহ), আবাসিক হোটেল, শপিংমল, বাণিজ্য কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক, মেলা, সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সমাবেশ, সিনেমা হল, ভ্রাম্যমাণ ফাস্ট ফুড, স্ট্রীট ফুড ও চা-এর দোকানের আড্ডাসহ জনসমাগম হয় এমন সকল কিছু পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা হয়েছে।
তবে খাদ্য সামগ্রী, ঔষধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সকল দোকানপাট, কাঁচা বাজার, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যথারীতি খোলা রয়েছে। এছাড়া, মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সাথে ভাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলার সীমানা সিল করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে এ জেলার সদর উপজেলাধীন ০২ টি যৌনপল্লীকে লকডাউন করা হয়েছে। যৌনপল্লীতে অবস্থারত যৌনকর্মীদের মাঝে পরিবার প্রতি ৩০ (ত্রিশ) কেজি হারে ১৫ মেঃ টন চাউল এবং নগদ অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দু:স্থ ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে ফরিদপুর জেলার করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে “দুস্থ ও অতি দরিদ্রদের সহায়তার জন্য” স্থানীয়ভাবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন তহবিল গঠনের লক্ষ্যে একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছে। হিসাবের নাম করোনা, চলতি হিসাব নম্বর-২০১০৭০২০০০৪৩৯, সোনালী ব্যাংক লি: কোর্ট বিল্ডিং শাখা, ফরিদপুর। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হতে এ জেলার জনগণকে অধিকতর সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী কাজ করতে শুরু করেছে।
রাস্তাঘাট, নর্দমা, বাসা-বাড়ি জীবানুমুক্ত করার লক্ষ্যে ফায়ার সার্ভিস, ফরিদপুর এবং এ জেলাধীন বিভিন্ন পৌরসভা ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিয়মিত জীবানুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয়পূর্বক জেলা পর্যায়ে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সম্ভাব্য সকল ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। সর্বশেষ জেলায় মোট ১৫৬৭ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮৩ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন হতে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন সূত্র।
তথ্য ও ছবি সংগৃহীত