কাসেম শরীফ

ধর্মতত্ত্ব

জাহেলি যুগে স্বামীর মৃত্যুর পর এক বছর পর্যন্ত নারী অন্য কোথাও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না এবং বাড়ির বাইরেও যেতে পারত না। এ নিয়ম চালু থাকায় মানুষ সমস্যার সম্মুখীন হতো। আল্লাহ তাআলা এ বিধান সহজ করে দিয়েছেন। এক বছরের পরিবর্তে শুধু চার মাস ১০ দিনের ইদ্দত নির্ধারণ করেছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের স্ত্রীরা চার মাস ১০ দিন প্রতীক্ষায় থাকবে…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৪)

এই চার মাস ১০ দিনে বিধবা নারীর ছয় করণীয়—১. স্বামীর ঘর-বাড়িতে অবস্থান করবে। ২. সাজসজ্জাহীন সাধারণ পোশাক পরিধান করবে। ৩. সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। ৪. অলংকার ব্যবহার করবে না। ৫. মেহেদি ও কাজল ব্যবহার করবে না। ৬. সরাসরি বিবাহে আবদ্ধ হওয়া বা বিবাহমূলক কথা বা কাজ করবে না। তবে প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে পারবে এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে।

এই সময় নির্ধারণের রহস্য কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ নেই। কিন্তু ইসলামের ভাষ্যকাররা এ বিষয়ে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা ইদ্দত পালনের বেশ কিছু হেকমত ও রহস্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই অকাট্য বা চূড়ান্ত নয়। কয়েকটি কারণে এই চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—এক. যাতে বিধবা নারী পেটে সন্তান আছে কি না সে বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এতে সন্তানের বংশ ও জন্মের পবিত্রতা বোঝা যাবে। পেটে সন্তান থাকলে তা আগের স্বামীর হবে। এবং মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে সন্তানের ভরণপোষণ হবে।

চার মাস ১০ দিন নির্ধারণের কারণ হলো, ৪০ দিন পর্যন্ত পেটে বীর্যের অবস্থায় থাকে। এরপর ৪০ দিন পর্যন্ত জমাট রক্তের আকৃতিতে থাকে। এরপর ৪০ দিন পর্যন্ত শরীরের আকৃতি তৈরি হয়। এ হলো মোট চার মাস। এরপর চতুর্থ মেয়াদে রূপ ও অবয়ব গঠন করা হয়, যার আনুমানিক সময় ১০ দিন ধরা হয়। সন্তান থাকলে এই চার মাস ১০ দিনে নড়াচড়ার দ্বারা বোঝা যায়। তা ছাড়া এ সময়টুকু স্বাভাবিক গর্ভধারণের অর্ধেক সময়। এতটুকু সময়ে গর্ভটা এমনভাবে প্রকাশ পায়, যা দেখলে যে কেউ তা বুঝতে পারে।

এখানে লক্ষণীয় যে আধুনিক যুগে প্রযুক্তির সাহায্যে খুব দ্রুত জানা যায় যে পেটে সন্তান আছে নাকি নেই। এই অজুহাতে ইদ্দত পালন ত্যাগ করার সুযোগ নেই। এর কারণ হলো—

প্রথমত, ইদ্দতের এই রহস্য কোরআন-হাদিসের বাণী নয়। এটি বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এই অভিমত সঠিক নাও হতে পারে। তাই সন্দেহমূলক এই অভিমতের কারণে কোরআন-হাদিসের অকাট্য বিধান বাদ দেওয়া যাবে না।

দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সব দেশের সব অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেটের সন্তানের বিষয়ে জানা সহজলভ্য নয়। সবার এটা করার সামর্থ্য নেই। অথচ ইসলামের বিধান সব মানুষের জন্য। তাই এমন এক পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে, যার আলোকে ধনী-গরিব, শহুরে-গ্রাম্য, উন্নত-অনুন্নত, পাহাড়ি-সমতলি সব মানুষ ইসলামের বিধান মোতাবেক জীবন যাপন করতে পারবে। চার মাস ১০ দিন পর ঠিকই জানতে পারবে যে পেটে মৃত স্বামীর কোনো স্মৃতি আছে কি না। এ ক্ষেত্রে কারো কারো অগ্রিম জেনে যাওয়া ধর্তব্য নয়।

তৃতীয়ত, চার মাস ১০ দিন সময় দেওয়ার আরো কিছু রহস্য আছে। সেগুলো হলো, এ সময়ে বিধবা নারী বেশি বেশি ইবাদত করার সুযোগ পায়। প্রিয়তম স্বামীর পরকালের জীবন সুন্দর হওয়ার জন্য আমল ও দোয়া করতে পারে। নিজের পারিবারিক জীবনের ভুল-ত্রুটি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ লাভ করে। ভবিষ্যতে নিজেকে খাঁটি মুসলিম নারী হিসেবে গড়ে তোলার অবকাশ পায়।

স্বামীর মৃত্যুর পর চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন স্বামীর অনুগ্রহের একধরনের কৃতজ্ঞতা। স্বামীর মৃত্যুর পর দ্রুত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে স্বামীর মৃত্যুতে শোক জানানো প্রেম ও ভালোবাসার দাবি। অনেক সময় স্বামীর মৃত্যুর সময় ছোট সন্তান থাকে। স্ত্রী অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে এই সন্তানের প্রতিপালন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ইসলামে সেসব শিশুর যথাযথ প্রতিপালনের তাগিদে স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালনের নির্দেশ দিয়েছে।