মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
নবী (সা.) প্রায়ই সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমাদের কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছ কি?’ এরপর যে স্বপ্ন দেখেছে, সে তার স্বপ্ন বর্ণনা করত। একদিন সকালে তিনি বলেন, গত রাতে আমার কাছে দুজন আগন্তুক এলো। তারা আমাকে উঠাল আর বলল, চলুন। আমি তাদের সঙ্গে চলতে লাগলাম। অতঃপর আমরা কাত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। দেখলাম, অন্য এক ব্যক্তি তার কাছে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলছে। আর পাথর গড়িয়ে সরে পড়ছে। তারপর আবার সে পাথরটির অনুসরণ করে তা পুনরায় নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে আবার একই আচরণ করছে। আমি সাথিদের বললাম, সুবহানাল্লাহ! এটা কী? তারা বলল, চলুন, চলুন।
আমরা চলতে লাগলাম, তারপর চিত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। এখানে দেখলাম এক ব্যক্তি লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে তার চেহারার একদিকে এসে এর দ্বারা তার কশ থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। তারপর লোকটি শোয়া ব্যক্তির অপরদিকে যাচ্ছে এবং প্রথম দিকের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করেছে অনুরূপ আচরণ অন্যদিকের সঙ্গেও করছে। ওই দিক থেকে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার প্রথমবারের মতো আচরণ করছে। (তিনি বলেন,) আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং (তন্দুর) চুলার মতো একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে শোরগোল ও নানা শব্দ ছিল। আমরা তাতে উঁকি মেরে দেখলাম, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী-পুরুষ আছে। আর নিচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করছে, তখনই তারা উচ্চ রবে চিৎকার করে উঠছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটি নদীর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। নদীটি ছিল রক্তের মতো লাল। আর দেখলাম, সেই নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অন্য এক ব্যক্তি আছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্র করে রেখেছে। আর ওই সাঁতাররত ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসছে, যে তার কাছে পাথর একত্র করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার সামনে মুখ খুলে দিচ্ছে এবং ওই ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে চলে গিয়ে আবার সাঁতার কাটছে এবং আবার তার কাছে ফিরে আসছে। আর যখনই ফিরে আসছে, তখনই ওই ব্যক্তি তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বলল, চলুন, চলুন।
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং এমন একজন কুিসত ব্যক্তির কাছে এসে পৌঁছলাম, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক কুিসত বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার কাছে আছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোকটি কে? তারা বলল, চলুন, চলুন।
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটি সবুজ-শ্যামল বাগানে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে বসন্তের সব রকমের ফুল আছে আর বাগানের মধ্যে এত বেশি দীর্ঘকায় একজন পুরুষ আছে, আকাশে যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। আবার দেখলাম, তার চারদিকে এত বেশি পরিমাণ বালক-বালিকা আছে, যত বেশি পরিমাণ আর কখনোও আমি দেখিনি। আমি তাদের বললাম, উনি কে? এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটি বিশাল (বাগান বা) গাছের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এমন বড় এবং সুন্দর (বাগান বা) গাছ আমি আর কখনো দেখিনি। তারা আমাকে বলল, এর ওপর চড়ুন। আমরা ওপরে চড়লাম। শেষ পর্যন্ত সোনা-রুপার ইটের তৈরি একটি শহরে গিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম। আমরা শহরের দরজায় পৌঁছলাম এবং দরজা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমরা তাতে প্রবেশ করলাম। তখন সেখানে কতক লোক আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল, যাদের অর্ধেক শরীর এত সুন্দর ছিল, যত সুন্দর তুমি দেখেছ, তার থেকেও বেশি। আর অর্ধেক শরীর এত কুিসত ছিল, যত কুিসত তুমি দেখেছ, তার থেকেও বেশি। সাথিদ্বয় ওদের বলল, যাও ওই নদীতে গিয়ে নেমে পড়ো। আর সেটি ছিল সুপ্রশস্ত প্রবহমান নদী। এর পানি যেন ধপধপে সাদা। ওরা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। অতঃপর ওরা আমাদের কাছে ফিরে এলো। দেখা গেল, ওদের ওই কুশ্রী রূপ দূর হয়ে গেছে এবং ওরা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেছে। (তিনি বলেন,) তারা আমাকে বলল, এটা জান্নাতে আদন এবং ওটা আপনার বাসস্থান। (তিনি বলেন,) ওপরের দিকে আমার দৃষ্টি গেলে, দেখলাম ধপধপে সাদা মেঘের মতো একটি প্রাসাদ রয়েছে। তারা আমাকে বলল, ওটা আপনার বাসগৃহ। (তিনি বলেন,) আমি তাদের বললাম, আল্লাহ তোমাদের বরকত দিন, আমাকে ছেড়ে দাও; আমি এতে প্রবেশ করি। তারা বলল, আপনি অবশ্যই এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়।
আমি বললাম, আমি রাতে অনেক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পেলাম, এগুলোর তাৎপর্য কী? তারা আমাকে বলল, আচ্ছা আমরা আপনাকে বলে দিচ্ছি। ওই যে প্রথম ব্যক্তিকে যার কাছে আপনি পৌঁছলেন, যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হলো ওই ব্যক্তি, যে কোরআন গ্রহণ করে তা বর্জন করে। আর ফরজ নামাজ ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে।
আর ওই ব্যক্তি, যার কাছে গিয়ে দেখলেন যে তার কশ থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল। সে হলো ওই ব্যক্তি, যে সকালে আপন ঘর থেকে বের হয়ে এমন মিথ্যা বলে, যা চারদিক ছড়িয়ে পড়ে।
আর যেসব উলঙ্গ নারী-পুরুষ, যারা (তন্দুর) চুলাসদৃশ গর্তের অভ্যন্তরে আছে, তারা হলো ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণীর দল।
আর ওই ব্যক্তি, যার কাছে পৌঁছে দেখলেন যে সে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে হলো সুদখোর।
আর ওই কুিসত ব্যক্তি, যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল আর তার চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সে হলো মালেক (ফেরেশতা)—জাহান্নামের দারোগা।
আর ওই দীর্ঘকায় ব্যক্তি, যিনি বাগানে ছিলেন। তিনি ইবরাহিম (আ.)। আর তাঁর চারপাশে যে বালক-বালিকারা ছিল, ওরা তারা, যারা (ইসলামী) প্রকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
আর ওই সব লোক, যাদের অর্ধেকাংশ অতি সুন্দর ও অর্ধেকাংশ অতি কুিসত ছিল, তারা হলো ওই সম্প্রদায়—যারা সৎ-অসৎ উভয় ধরনের কাজ মিশ্রিতভাবে করেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ৭০৪৭)