প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় গ্রেপ্তার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ইভ্যালির’ সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে আজ রাজধানীর গুলশান থানায় হস্তান্তর করা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসা থেকে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর র্যাব সদর দপ্তরে নেওয়া হয় তাঁদেরকে।
গতকাল বিকেলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিকেল ৪টার দিকে স্যার সৈয়দ রোডের একটি ৯ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় রাসেলের ফ্ল্যাটে তাঁদের অভিযান শুরু হয়। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রাসেল ও তাঁর স্ত্রীকে বাসা থেকে বের করে র্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে তাঁদের।
বেশ কিছুদিন ধরে ইভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা চলেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে গ্রাহকরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার রাতে রাসেল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় অর্থ আত্মসাৎ ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে মামলা করেন আরিফ বাকের নামের একজন। এরপর গতকাল বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৫/৫এ স্যার সৈয়দ রোডের নিলয় টাওয়ারে রাসেলের বাসায় অভিযানের খবরে গ্রাহকদের অনেকে তাঁর বাসার সামনে ভিড় করে। রাসেলকে র্যাব নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবাদ জানিয়ে অর্ধশতাধিক লোককে সেখানে বিক্ষোভ করতেও দেখা যায়। নিজেদের ইভ্যালির গ্রাহক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তারা রাসেলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানায়। তাদের একজন বলেন, ‘রাসেল সময় চেয়েছিলেন, তা না দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়নি। রাসেলকে সময় দেওয়া হলে গ্রাহকরা উপকৃত হতো।’
রেদোয়ান নামের অন্য একজন গ্রাহক বলেন, ইভ্যালির রাসেলকে যথাযথ নজরদারির মধ্যে রেখে আরো কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে তাঁকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত বা পণ্য দিতে বাধ্য করা যেতে পারে। তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে গ্রাহকরা পণ্য বা টাকা কিছুই পাবে না।
এ সময় আরো অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্ণধারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কেউই তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পায়নি।’
এজাহারে যা বলা হয়েছে : মামলার বাদী আরিফ বাকের এজাহারে বলেছেন, ইভ্যালির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে তিনি বন্ধুদের নিয়ে গত ২৯ মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোটরসাইকেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেন। পণ্যের অর্ডার বাবদ মূল্য বিকাশ, নগদ ও সিটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিশোধ করেন। পণ্য সাত থেকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা দেয়নি। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে কোনো সমাধান পাননি তিনি। পণ্যের জন্য আগাম অর্থ দিয়ে না পাওয়ার পাশাপাশি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এজাহারের বরাত দিয়ে গুলশান থানার পুলিশ জানায়, আরিফ বাকের বিভিন্ন সময় পণ্যের মূল্য বাবদ তিন লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকা অনলাইন ব্যাংকিং ও একটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। পণ্য সাত থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে দিতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরতের অঙ্গীকার করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির গ্রাহকসেবা শাখায় (কাস্টমার কেয়ার সেন্টার) যোগাযোগ করে পণ্য পেতে ব্যর্থ হন। এর আগে যতবার যোগাযোগ করা হয়, ততবারই তারা দেব-দিচ্ছি বলে টালবাহানা করে।
আরিফ অভিযোগ করেন, ‘আমি বহুবার ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ারে ফোন করি। প্রতিবার তারা আমার পণ্যগুলো শিগগিরই দিচ্ছে বলে আশ্বস্ত করে যাচ্ছিল। ইভ্যালি পণ্য অথবা টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার পর এক পর্যায়ে আমি তাদের অফিসে যাই। তখন প্রতিষ্ঠানটির সিইও মো. রাসেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। এরপর সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর বন্ধুদের নিয়ে আমি ইভ্যালি অফিসে গিয়ে পণ্যের অর্ডার সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এক পর্যায়ে সিইও রাসেল উত্তেজিত হয়ে তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে আমাকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন এবং পণ্য কিংবা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে প্রাণনাশের হুমকিও দেন।’
পণ্য না পাওয়ায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জানিয়ে আরিফ বলেন, ‘ইভ্যালি পণ্য বিক্রয়ের নামে নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। আমার মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে আনুমানিক ৭০০-৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।’
জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন একজন গ্রাহক। মামলায় ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের নাম উল্লেখ করা হয়। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার বাসিন্দা মো. রাজ মামলাটি করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাসেল ইভ্যালি প্রতিষ্ঠা করেন। লোভনীয় অফার দিয়ে তাঁদের ক্রেতা টানার কৌশল বাজারে সাড়া ফেলে, কিন্তু অনেকে ক্রেতাই অর্থ দিয়ে পণ্য পায়নি। অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাইয়ে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি টাকা। আর ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। ৩৩৮ কোটি টাকাই কম্পানির কাছে নেই।