দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অপরিহার্য খাদ্য উপাদান পেঁয়াজের কেজি দেড় শ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মাসখানেক সময় ধরে অস্থিতিশীল হয়ে আছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। কখন কত দামে বিক্রি হচ্ছে তা বলা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালের দাম পাল্টে যাচ্ছে বিকেলেই। আর দাম পরিবর্তনের ঝোঁকটা বরাবরই ঊর্ধ্বমুখী। তবে আশার কথা হলো, মিসর থেকে আসছে পেঁয়াজের বড় চালান। ছয়-সাত দিনের মধ্যেই সেই চালান দেশে এলে কমবে পেঁয়াজের দাম।
গতকাল বুধবার ঢাকার বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৩০ থেকে ১৪৪ টাকা কেজি দরে।
এক বাজারের সঙ্গে অন্য বাজার, এমনকি পাশাপাশি দোকানেও পেঁয়াজের দামে হেরফের চলছে। যে যেভাবে পারছে ক্রেতার পকেট কেটে নিচ্ছে। আর দামে এই সমন্বয়হীনতা খোদ ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করছেন। অথচ বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে প্রশাসনিক উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো নয়। অভিযান চললেও তা নামকাওয়াস্তে। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃৃপক্ষের হিসাবেই কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গতকাল দিনভর ঘুরে দেখা গেছে, পেঁয়াজের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। খুচরা বা পাইকারি দোকান সব স্থানেই পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ রয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা দোহাই দিচ্ছেন সরবরাহ সংকটের।
জানা গেছে, গত শনিবার হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকায় উঠে যায়। এর পরদিনই আরেক দফা উল্লম্ফন, কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। তিন দিনের ব্যবধানে গতকাল পেঁয়াজের কেজি দেড় শ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ভোক্তা-ক্রেতারা বলছে, দীর্ঘদিন ধরে পেঁয়াজের দাম নিয়ে নৈরাজ্য চললেও সরকার বাজারে দৃশ্যমান কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। নিয়মিত কঠোর অভিযান চললে পেঁয়াজের বাজার এতটা লাগামহীন হতো না। অতি মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের নজরদারির গাফিলতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট উজাড় করছেন।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের দোতলায় মামা-ভাগনে জেনারেল স্টোরে পেঁয়াজের দাম শুনে বেসরকারি চাকুরে আব্দুল মোতালেব খেপে যান। আরেক ক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার মুখে বলছে এটা করবে, ওটা করবে। আসলে কিছুই করছে না। অথচ কয়েকজনকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই ব্যবসায়ীরা সোজা হয়ে যাবে।’
বাজারে খুচরা বিক্রেতারা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি। তবে দু-একটি সুপারশপে দাম ১৫৪ টাকা। আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। সুপারশপে তা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪৪ টাকায়। পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১৩০ থেকে ১৩৫ এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৯২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল।
এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১১৪ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ১১১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হবে। অর্থাৎ সরকারের হিসাবেই দেশি পেঁয়াজে ৪০ ও আমদানি করা পেঁয়াজে ৩৩ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে।
পাইকারি বাজারেও অধিদপ্তর নির্ধারিত দাম মানা হচ্ছে না। সংস্থাটি বলছে, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৯৭ ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৮৭ টাকার মধ্যেই বিক্রি করার কথা। অথচ কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজের আড়তগুলোতে দেশি ১৩০ থেকে ১৩৫ এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৯২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পেঁয়াজ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের প্রতিদিনের দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেই হিসাব ধরেই বাজারে অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা না করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি। ফড়িয়া-পাইকাররা যাতে বেশি দাম নিতে না পারে সে জন্য তাদেরকে কেনা ও বিক্রির রসিদ সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া দামের বেশি নিলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে বিষয়টি আরো কঠোরভাবে নজরদারি করা হবে।’
এদিকে আমদানিকারকরা সংকটের অজুহাত তুলছেন। একই সঙ্গে স্বীকার করছেন যে বাজারে দামের কোনো সমন্বয় নেই। খুচরা বিক্রেতারা যে যার মতো দামে বিক্রি করছেন। পেঁয়াজের আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মাজেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেয়াজের সংকট রয়েছে এটা সত্য। আবার খুচরা বিক্রেতারা অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে তাও ঠিক। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া দামে এখন পেঁয়াজ বিক্রির সুযোগ নেই।’
পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করা একটি সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ছয়-সাত দিনের মধ্যে মিসর থেকে পেঁয়াজের বড় কয়েকটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে চলে আসবে। এই চালানগুলো এলে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে আসবে।