বাংলা নববর্ষের ক্রমবিবর্তনে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া। বিশেষ ঘটনা স্মরণে মানুষ সময় বা তারিখের ব্যবহার করে থাকে। যেমন—সংগ্রামের বছর, বন্যার বছর, আকালের বছর, আবিসিনিয়ায় আবরাহার হস্তীবাহিনী ধ্বংস হওয়ার ফলে ‘হস্তীবর্ষ’ চালু হয়। ইতিহাসে দেখা যায়, বিশেষ ঘটনাকেন্দ্রিক সন ব্যবস্থা। ঈসা (আ.) স্মরণে খ্রিস্টাব্দ বা ঈসায়ি সন। প্রিয় নবী (সা.)-এর হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে প্রথম বছর ধরে ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন।

বিশ্বব্যাপী ভয়াল আতঙ্ক করোনায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। গবেষণা ও প্রতিরোধের সব প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে বাঁচার করুণ আর্তিতে দীর্ঘশ্বাস এখন সর্বত্র। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে মুনাজাত “করোনা বর্ষ না হোক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ’। বরং প্রত্যাশা—…মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা…” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রচনাকাল : ২০ ফাল্গুন ১৩৩৩, ৪ মার্চ ১৯২৭ খ্রি.)।

মহান আল্লাহ কষ্ট দেওয়ার জন্য বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেননি। করোনা সংক্রমণ মহান আল্লাহর পরীক্ষা। বাংলা নববর্ষেও মনে রাখতে হবে পবিত্র কোরআনের অভয়বাণী—‘…আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইয়ো না…।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৭)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইয়ো না…।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)

যা-ই হোক, ঈমানি চেতনায় স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৭। মুসলিম লোকভাবনার ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র আবহে উচ্চারণ :

‘আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ,

কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ।’

অথবা,

‘বৈশাখ মাসেতে গাছে আমের কড়ি

পুষ্প ফুটে পুষ্প ডালে ভ্রমর গুঞ্জরি।’

(কমলা পালা)

ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণে সন তারিখের প্রচলন মুসলিম শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহীশুরের শাসক টিপু সুলতান প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের বর্ষকে সূচনায় এনে বিশেষ রীতিতে ‘মুহাম্মদী সন’ প্রবর্তন করেন। আকবরের ‘ফসলি সন’ গণনা রীতিতে চট্টগ্রাম ও আরাকানে প্রচলিত হয় ‘মগি সন’। পার্বত্য জনপদে ‘বৈসাবি’ নামে বর্ষবরণের রীতি প্রচলিত। পার্বত্য তিনটি উৎসবের আদ্যাক্ষর দিয়ে গঠিত শব্দ ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু ও মারমাদের কাছে সাংগ্রাই, অন্যদিকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ বা ‘বৈ.সা.বি.। হিজরি সনের আদলে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল ‘বিলায়তি সন’, ‘আসলি সন’, ‘ইলাহি সন’, ‘জালালি সন’ ইত্যাদি। এসব সন গণনা রীতির সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর স্মৃতি ও ইসলাম-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত স্পষ্ট।

বাঙালির গর্ব, বাংলা সনের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পৃক্ততা। পবিত্র কোরআনে ১২ মাসে এক বছর প্রসঙ্গে আছে : ‘নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ ১২টি মাস নির্ধারণ করেছেন…।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)

বর্ষপরিক্রমা প্রসঙ্গে আল-কোরআনের বাণী :

‘তিনি সূর্যকে প্রচণ্ড দিপ্তি দিয়ে

চাঁদ বানিয়ে দিলেন স্নিগ্ধতা ভরে,

বছর গণনা ও হিসাবের তরে।’

 (কাব্যানুবাদ, সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)

১২০১ খ্রি. ৫৯৮ হিজরি মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয়ের ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়।

সম্রাট আকবর ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন গণনা করেন, যার সূচনা ধরা হয় তাঁরই মসনদে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রি., ৯৯২ মতান্তরে ৯৯৩ হিজরিকে। আকবরের ‘ফসলি সন’ যখন চালু হয়, তখন সুবে বাংলায় মহররম ছিল বৈশাখ মাস। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস হয়ে যায় বৈশাখ। ১৯৫৪ খ্রি. ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকার গঠিত হলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালু করেন ‘বৈশাখী ভাতা’।

আমরা মুসলমান। মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি মহান আল্লাহর আদেশ ও প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত ও ইহ-পারলৌকিক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত।

কাজেই বাংলা নববর্ষও হতে পারে আমাদের উৎসব। কাজেই আমরা একে এভাবে উদ্যাপন করতে পারি—

নববর্ষকে আল্লাহর নিয়ামত মনে করে শুকরিয়া আদায়।

নববর্ষের আনন্দ দুস্থ-দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করা।

নববর্ষে অভাবী মানুষের খোঁজ-খাতির, তাদের খাদ্য ও পোশাক দান করা।

পহেলা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন।

পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন।

পহেলা বৈশাখ দেনা-পাওনা হালনাগাদ করার দিন।

পহেলা বৈশাখ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন।

ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন হতে পারে এটি।

এবারের নববর্ষে এমন কিছু হোক, সেই প্রত্যাশায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

[email protected]