করোনার তাণ্ডবে থমকে গেছে পৃথিবীর কলরব। থেমে গেছে কৃষক, শ্রমিক আর খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারের চাকা। একমুঠো ভাতের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে ছিন্নমূল অসহায় জনতা। শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জঠরযন্ত্রণার আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে পাড়া-মহল্লার নিস্তব্ধ পরিবেশ। মহামারির ভয়াল থাবাকে তুচ্ছজ্ঞান করে সড়কে ক্ষুধার্থ জনতার করুণ আর্তনাদ।
কৃষক-শ্রমিক আর খেটে খাওয়া এই জনতার ভিড়ে আমরা যারা মহান রবের অফুরন্ত নেয়ামতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারী হয়েছি, সম্পদ অর্জনে বা প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচায় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যোগ করেছি অসংখ্য পাপের পাহাড়। তাদের জন্য নিজেদের সম্পদকে পূতপবিত্র করে নেওয়ার, প্রাত্যহিক জীবনের আমলনামায় সংযোজিত পাপের পাহাড়কে মিটিয়ে নেওয়ার এক মহা সুযোগ হতে পাবে বৈশ্বিক এই মহা সংকটে ত্রাণ সহায়তা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করো, তবে আমি তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করব এবং অবশ্যই তোমাদের প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে।’ (সুরা : মায়িদাহ, আয়াত : ১২)। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর এই উত্তম ঋণকে করজে হাসান বলে নামকরণ করা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে কাটা, আলাদাকরণ বা বিচ্ছিন্নকরণ। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এখানে আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অর্থ হলো, নিজ সম্পদ থেকে কিছু আলাদা করে তা গরিব, অসহায় ও প্রকৃত অভাবীদের মধ্যে মহান রবের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে খরচ করা।
যার প্রতিদান হিসেবে তিনি ঘোষণা করেছেন পাপমোচনের মহা সুসংবাদ। আর সাধারণ সময়ের দান-অনুদানের চেয়ে এই বৈশ্বিক সহা সংকটের সময়ের ত্রাণ আর দান-সহায়তা অনেক বেশি গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দাবি রাখে। কারণ এখনই মানুষ প্রকৃতপক্ষে সহায়তা প্রত্যাশী। অন্য সময়ে একজন গরিব ও অসহায় মানুষ ইচ্ছা করলে শারীরিক শ্রম দিয়ে শত কষ্ট হলেও নিজ ও পরিবারের শিশু-কন্যা-জায়াদের চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হতে পারে। কিন্তু এখন ইচ্ছা করলেও ঘরের বাইরে গিয়ে শ্রম বিক্রির সেই সুযোগ তার আর অবশিষ্ট নেই।
এ ছাড়া আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের এই নিয়ামত কারো জন্যই চিরস্থায়ী নয়। এমন একদিন আসতে পারে, যেদিন আমি বা আমার বংশধররা অন্যের সাহায্য প্রত্যাশী হয়ে যেতে পারে। সেই চিন্তায়ও এই অনাথ মানুষগুলোর পাশে আমাদের দাঁড়ানো উচিত। ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি ব্যয় করো, আমিও তোমার প্রতি ব্যয় করব।’ (বুখারি, হাদিস ৫৩৫২)
গরিব ও অসহায়দের মধ্যে সাধ্যমতো খরচ করলে সম্পদ কমে না। বরং মহান আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তা নানা উপায়ে বহুগুণ বৃদ্ধি করে আমাদের ফিরিয়ে দেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারীরা এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের দেওয়া হবে বহুগুণ বেশি এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ১৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সদকা করলে সম্পদের হ্রাস হয় না। (মুসলিম, হাদিস নম্বর ৬৪৮৬)
সম্মানিত পাঠক, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সম্পদ মহান আল্লাহর দান। যার পূর্ণ ও প্রকৃত মালিকানা তাঁরই। আমাদের শুধু নির্দিষ্ট মেয়াদে তা ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর পরই এই সম্পদ অন্যের হয়ে যাবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো, সময় থাকতেই পরকালের জন্য এ সম্পদ থেকে খরচ করে পরকালীন জীবনের রাস্তা সুগম করা। বেশি বেশি দান-সদকার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী-অনাথদের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে আল্লাহর নেয়ামতের যথাযথ শুকরিয়া আদায়। ভ্রাতৃত্বের হক পূরণে সচেষ্ট থাকা। মহান আল্লাহ আমাদের জন্য তা সহজ করে দিন। আমিন।
লেখক : অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
ই-মেইল : [email protected]