মুফতি ইবরাহিম সুলতান 

দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের সড়কপথে চলাফেরা করতে হয়। মানুষের এই চলার পথ যেন নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হয় এ জন্য ইসলামে রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। যেগুলো মেনে চললে একজন পথচারী যেমন বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা থেকে মুক্তি পাবে, তেমনি পরকালে পাবে এর সওয়াব ও পুরস্কার। নিম্নে রাস্তা চলাচলে পথচারীর করণীয় প্রসঙ্গে ইসলামের বিশেষ কিছু নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।

সড়কপথ নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন রাখা : রাস্তাঘাটে চলাফেরায় ইসলামের বিশেষ একটি নির্দেশনা হলো সড়কপথ অনিরাপদ ও আবর্জনা করে কাউকে কষ্ট না দেওয়া। যেমন, যত্রতত্র পরিত্যক্ত প্যাকেট ও বোতল ফেলা। রাস্তার পাশে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও যেকোনো জায়গায় যাত্রী উঠানামা করা। রাস্তা দখল করে ফুটপাতগুলোতে পণ্যের পসরা বসিয়ে পথ চলাচলে বাধাগ্রস্ত করা। এ ছাড়া আরো বিভিন্ন কারণ রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ কষ্ট পেয়ে থাকে। অথচ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের শাখা সত্তরটিরও কিছু বেশি। অথবা ষাটটির কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই—এ কথা স্বীকার করা, আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৯)। আরেক বর্ণনায় এসেছে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পথ হতে পাথর, কাঁটা ও হাড় সরানো তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৬)

চালকদের সচেতনতা জরুরি : যানবাহনে যেহেতু মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ বিভিন্ন ধরনের যাত্রী থাকে, তাই তাদের প্রতি খেয়াল রেখে সচেতনতার সঙ্গে যানবাহন আস্তে-ধীরে চালানো ইসলামের নির্দেশনা। তা ছাড়া দুর্ঘটনা এড়িয়ে যেতে এর কোনো বিকল্প নেই। বিখ্যাত সাহাবি আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবী (সা.) তাঁর কতক স্ত্রীর নিকট এলেন। তখন তাঁদের সঙ্গে উম্মু সুলায়মও ছিলেন। নবী (সা.) বললেন, সর্বনাশ, হে আনজাশাহ! তুমি (উট) ধীরে চালাও। কেননা তুমি কাচপাত্র (মহিলা) নিয়ে চলেছ। বর্ণনাকারী আবু কিলাবা বলেন, নবী (সা.) ‘সাওকাকা বিল কাওয়ারীর’ বাক্য দ্বারা এমন বিষয়ের প্রতি ইশারা করলেন, যা অন্য কেউ বললে তোমরা তাকে ঠাট্টা করতে। (বুখারি, হাদিস : ৬১৪৯)

দৃষ্টি অবনত রাখা : দুর্ঘটনা এড়িয়ে যেতে প্রয়োজন চতুর্দিকে দৃষ্টি রেখে চলা। প্রয়োজন না হলে দৃষ্টি অবনত রেখে কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকাই শ্রেয়। পুরুষদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্কৃষ্ট পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত।’ আর নারীদের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩০-৩১)

অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা : একবারের ঘটনা, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি পথে বিপদে পড়েছি (অর্থাৎ আমার বাহন মারা গেছে), আমার জন্য একটি বাহনের ব্যবস্থা করে দিন। নবীজি (সা.) বলেন, তোমাকে দেওয়ার মতো কোনো বাহন আমার কাছে নেই। তবে তুমি অমুকের কাছে যাও। আশা করি সে তোমাকে বাহনের ব্যবস্থা করে দিবে। অতঃপর সে ওই ব্যক্তির কাছে গেল এবং সে বাহনের ব্যবস্থা করে দিল। পুনরায় সে (পথিক) নবীজি (সা.)-এর কাছে এলো এবং তা জানাল। তখন রাসুল (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি (যেকোনো উপায়ে) কোনো সত্কর্মের পথ দেখাবে সে ওই সত্কর্মকারীর সমান প্রতিদান পাবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৯)

পথহারাকে পথ দেখানো : চলার পথে এমন অনেক পথিক থাকে যারা গন্তব্যের রাস্তা ভুলে যায় এবং অনেক অন্ধ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী থাকে যারা কারো সাহায্য ছাড়া রাস্তা পারাপার হতে পারে না। তাদের সাহযোগিতা করাও ইসলামের বিশেষ একটি নির্দেশনা। হাদিস শরিফে তাদের এই সহযোগিতাকে আল্লাহর রাসুল (সা.) সদকা বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘পথ না চেনা ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দেয়া তোমার জন্য একটি সদকা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৬)

বোঝা বহনকারীর সাহায্য করা : সফরে বের হলে অনেকেই ভারী বোঝা বহন করে থাকে। বোঝা বহন কষ্টসাধ্য না হলেও অনেক সময় দেখা যায় যানবাহনে বোঝা ওঠানো-নামানোর সময় কারো প্রয়োজন দেখা দেয়। যে পথিক ওই মুহূর্তে তার সাহায্য করবে ইসলামে তার জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার।

এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে সওয়ারির ওপর আরোহণে সাহায্য করা অথবা তার মালামাল সওয়ারির ওপরে তুলে দেয়াও একটি সদকা।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২২৫)

অহংকার ও দম্ভভরে না চলা : রাস্তাঘাটে অহংকার ও দম্ভভরে না চলা, এটা ইসলামের নির্দেশনা। যেমন রাস্তায় কাউকে নিজের সামনে যাওয়ার সুযোগ না দেওয়া, অন্যের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা, যানবাহন আটকে রেখে নিজের পথ প্রশস্ত করা, দম্ভভরে হাঁটা ইত্যাদি। এসবই বর্জনীয়। কারণ আল্লাহ তাআলা এসব শ্রেণিকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না। তুমি তো পদভারে ভূমিকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৭)