ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা 

সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, মিলন-বিরহ মানবজীবনের নিত্যসঙ্গী। শুধুই সুখের জায়গা জান্নাত, আর দুঃখের জায়গা জাহান্নাম। কিন্তু পৃথিবীতে বিপরীতমুখী এই দুই অবস্থা থাকবে। সুখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আর দুঃখে ধৈর্য ধারণ করা ঈমানের দাবি। ঈমানদার সুখে আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যায় না, তেমনি দুঃখে ধৈর্যহারা হয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয় না। বিভিন্নভাবে মানুষের জীবনে দুঃখ-বেদনা আসে। তবে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ-বেদনা কঠিন বাস্তবতা। প্রিয়জনের মৃত্যুর ফলে পাওয়া দুঃখকেই সাধারণত শোক বলা হয়।

নবী (সা.)-এর জীবনে শোক : নবী (সা.)-এর জীবনেও শোক এসেছে। বিভিন্ন সময় তাঁর প্রিয়জনদের হারাতে হয়েছে। জন্মের আগে পিতাকে আর ছয় বছর বয়সে মমতাময়ী মাকে হারান। আট বছর বয়সে দাদাকে হারিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর তাঁর লালনপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন চাচা আবু তালিব। নবুয়তের দশম বছরের রমজান, মতান্তরে শাওয়াল মাসে নবী (সা.)-এর চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তিন বা পাঁচ দিনের ব্যবধানে তাঁর সহধর্মিণী খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ইন্তেকাল করেন। নবী (সা.)-এর জীবনে এই দুজনের অবদান ছিল অনেক বেশি। তাঁরা দুজনই ঘরে ও ঘরের বাইরে নবী (সা.)-কে শক্তি-সাহস জোগাতেন এবং কোরাইশ কাফিরদের জুলুম-অত্যাচার থেকে যথাসাধ্য রক্ষা করতেন। তাঁদের ইন্তেকালে রাসুল (সা.) শোকার্ত হয়ে পড়েন। নবী (সা.)-এর এমন প্রিয় দুজন ব্যক্তির ইন্তেকালের কারণে ওই বছরকে ‘আমুল হুজুন’ বা ‘শোকের বছর’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। [মুহাম্মদ ইদরিস কান্ধলভি, সিরাতুল মুস্তাফা, ১ম খণ্ড (দেওবন্দ : দারুল কিতাব, তা. বি.), পৃ. ২৭১]

এ ছাড়া নবী (সা.)-এর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ফাতিমা (রা.) ছাড়া সবাই তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। সন্তান হারানোর শোক তাঁকে সইতে হয়েছে।

শোক প্রকাশের পদ্ধতি : আপনজনের মৃত্যুতে সীমাহীন কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ এই কষ্টের বিনিময় দান করবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব) বলে আল্লাহর দিকে ধাবিত হতে হবে। ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। মনকে শক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি যার কোনো প্রিয়জনকে উঠিয়ে নিই আর সে ধৈর্য ধারণ করে এবং নেকির আশা রাখে আমি তাকে জান্নাত দিয়েই সন্তুষ্ট হব।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০১)

এর পরও নীরব কান্নায় চোখ অশ্রুসজল হবে। মনের বেদনায় চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকবে। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু চিৎকার করে, ইনিয়ে-বিনিয়ে, বুক চাপড়ে কাঁদা, মাতম করা এবং জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা ইসলামের পদ্ধতি নয়। এগুলো জাহিলি যুগের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি। আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যে শোকে গালে চপেটাঘাত করে, জামার অংশবিশেষ ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো চিৎকার করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৩৫; মুসলিম, হাদিস : ২৯৬)

বিধবা নারীর শোক প্রকাশ : স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর ইদ্দত পালনের একটি বিষয় রয়েছে। গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত আর গর্ভবতী না হলে চার মাস ১০ দিন পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয়। অর্থাৎ এই সময়টায় অন্যত্র বিয়েশাদি করা যায় না। ইদ্দত চলাকালীন শোকের প্রভাব থাকে। সাজসজ্জা, বিয়েশাদি পরিহার করে অনেকটা নির্জনতায় সময় কাটাতে হয়। এরপর স্বাভাবিক জীবন শুরু হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের স্ত্রীরা চার মাস ১০ দিন প্রতীক্ষায় থাকবে। যখন তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করবে তখন যথাবিধি নিজেদের জন্য যা করবে তাতে তোমাদের কোনো গুনাহ নেই। তোমরা যা করো আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৪)

শোকার্তের প্রতি সমবেদনা : শোকার্ত মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়া, সমবেদনা জানানো, যথাসাধ্য খোঁজখবর নেওয়া ও সহযোগিতা করা ইসলামের অন্যতম মানবীয় সদাচরণ। বিধবা, এতিম ও সন্তানহারা মায়ের প্রতি সমবেদনা প্রদর্শন করতে নবী (সা.) বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তাদের শোক বর্ণনাতীত। তাদের অসহায়ত্ব সীমাহীন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সন্তানহারা মাকে যে সান্ত্বনা দেয় জান্নাতে তাকে বিশেষ পোশাক পরানো হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৭৬)

নবীজি আরো বলেন, ‘স্বামীহারা নারী ও মিসকিনের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো অথবা রাতে নামাজে দণ্ডায়মান ও দিনে রোজা পালনকারীর মতো।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩৫৩)

এতিমের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি ও এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে (নিকটবর্তী) থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলির মাঝে সামান্য ফাঁক করলেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৯৯৮)

অতীতের শোক প্রকাশ : শোক এক দিনেই শেষ হয়ে যায় না। ক্রমান্বয়ে অনেকটা সহনীয় হয়। তবে প্রিয়জনের মৃত্যুশোক স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনের কোঠায় ভেসে উঠে মনকে ব্যথিত করে। সে ক্ষেত্রে আবারও ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে আল্লাহর দিকে ধাবিত হতে হবে। প্রিয়জনের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করতে হবে। ইস্তিগফার করতে হবে। সুযোগমতো কবর জিয়ারত করতে হবে। হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো বিপদে পড়ে অতঃপর যখন তা স্মরণ হয় তখন ‘ইন্নালিল্লাহ…’ বলে, আল্লাহ তাকে তেমন নেকি দেবেন যেমন নেকি দিয়েছিলেন বিপদগ্রস্ত হওয়ার দিন।” (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৯৬৯৫)। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।