ইউরোপে ইসলাম, মুসলিম উম্মাহ ও মহানবী (সা.)-এর শানে সংঘটিত অসৌজন্যমূলক ও অবমাননাকর ঘটনাবলির বিস্তারে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল অমুসলিমরা ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং ইউরোপে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ঠিক যেভাবে মুসলিম বিশ্ব থেকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হওয়ার পর প্রাচ্য ও পশ্চিমের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক স্থাপন, ইসলামী গবেষকদের স্বীকৃতি ও পশ্চিমাদের ইসলাম গ্রহণের কারণে ইউরোপে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর অনুগ্রহে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা, ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পরিমাণ বেড়েছে। পশ্চিমাদের বৈরী মনোভাবের কারণে পশ্চিমা সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের ভেতর ইসলামের ব্যাপারে কৌতূহল বেড়েছে। কেননা তারা এখন পশ্চিমা বিশ্বের ইসলামবিরোধিতার কারণ জানতে আগ্রহী। ফলে তারা পশ্চিমা সভ্যতার প্রতারণা ও চাতুর্য সম্পর্কে জেনে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের সামনে পশ্চিমাদের সভ্যতার জনক ও পথপ্রদর্শক এবং মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা ও সাম্যের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার দাবির বাস্তবতাও স্পষ্ট হচ্ছে। বিপরীতে তাদের সামনে ইসলামের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে শত্রুর ঘরে ইসলামের পক্ষে আওয়াজ উঁচু হচ্ছে।
বহু নওমুসলিম স্বীকার করেছেন তাঁরা ইসলামী জীবনপ্রণালী দ্বারা প্রভাবিত। ইসলামী জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁরা সুখ, স্বস্তি ও সৌভাগ্য লাভ করেছেন, ইসলাম তাঁদের পারস্পরিক আস্থা ও মনুষ্যত্বের প্রতি সম্মান করতে শিখিয়েছে এবং ইসলামবিরোধী প্রচার-প্রচারণার কারণে তাঁদের মনে যেসব সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়ে গেছে। এসব নওমুসলিমের অনেকেই পরে ইসলামের একনিষ্ঠ প্রচারক হয়েছেন, ইসলামের সেবায় ও ইসলাম রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আসাদ ও মারিয়াম জামিলার নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। যাঁরা পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধকার প্রকাশ করে দিয়েছেন। পরে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হয়। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন রজা জারুদি, মরিস বুকাইলি, মুরাদ হফম্যান, ইউসুফ ইসলাম প্রমুখ। এসব প্রাজ্ঞ মানুষ শুধু আনুষ্ঠানিক ইসলাম গ্রহণ করেননি; বরং ইসলাম ও ইসলামী জীবন নিয়ে দীর্ঘ অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা লাভের পর পরিতৃপ্ত হয়েই তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিজেদের জীবন ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেন।
একসময় মুসলিমরাই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ইসলাম রক্ষায় কাজ করত, পরবর্তীকালে এমন সব লোক এ দলে শামিল হন, যাঁরা খুব কাছ থেকে পশ্চিমা সভ্যতা দেখেছেন এবং পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যাঁরা পশ্চিমা সমাজের নাস্তিক ও আস্তিক উভয় ধারা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। এরপর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিমা সমাজের ধ্বংসযাত্রা নিয়ে মুখ খুলেছেন, ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। যা বহু মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও লেখককে প্রভাবিত করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে।
এ বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আন্দোলনের ফলে পুরো পৃথিবীতে ইসলামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার অপবাদ সত্ত্বেও ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। স্বয়ং ইউরোপে ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাস পাঠের আগ্রহ বেড়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে জানা যায়, ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন— ডেনমার্কে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের পর সে দেশে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী পাঠ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ডাচ ভাষায় প্রকাশিত সিরাতের বইয়ের সংকট তৈরি হয় এবং বহু অমুসলিম তখন মুসলিম হয়। এমন বহু দৃষ্টান্ত এখানে দেওয়া যাবে, যা প্রমাণ করে ইসলামবিরোধিতাই সব সময় ইসলামের অগ্রযাত্রার কারণ হয়েছে। মহান আল্লাহ যেন এদিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, ‘হয়তো তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ করবে এবং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৬)
আশাব্যঞ্জক এই চিত্র আমাদের একটি নতুন কর্মপন্থার নির্দেশনা দেয়। তা হলো—হামলার বিপরীতে হামলা, আক্রমণের বিপরীতে পাল্টাআক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়। এতে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যই শুধু খর্ব হয়। প্রত্যক্ষ আক্রমণ, আঘাত ও সমালোচনার উত্তরে প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তর, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ, শান্তিপূর্ণ আলোচনা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহনশীলতাই সময়ের শিক্ষা ও দাবি। শান্তি ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতির সুফল এখন স্পষ্ট। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে ‘আসনা’-এর উদ্যোগে একটি আন্ত ধর্ম সম্মেলন হয়েছে। তাতে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, শিখ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণকারী সবাই একমত হয়েছে যে, ইসলামের নামে সব ধরনের অপপ্রচার বন্ধ করা হোক। কেননা ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। সুতরাং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও কঠোরতার কারণে অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা করা যাবে না। শান্তিপূর্ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানামুখী প্রচেষ্টার কারণে ইউরোপীয় সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের অনেকে ইসলাম, মুসলমান ও মহানবী (সা.)-এর ওপর নগ্ন আঘাতের সমালোচনা করছেন এবং তাঁরা স্বজাতির এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। যেমন—পাদ্রি টেরি জনস কোরআনের কপি পোড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘এমন আক্রমণাত্মক কাজ প্রান্তিকতা বৃদ্ধি করবে এবং চরমপন্থা মাথাচাড়া দেবে। সব ধর্মের প্রতি সম্মান করা এবং যারা ঘৃণা ও শত্রুতা ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের নিন্দাজ্ঞাপন করা উচিত।’ অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা শুধু ওবামা বলেননি; বরং যাঁরাই উদার মনে ইসলামের সমালোচনা ও তার পরিণতি নিয়ে চিন্তা করেছেন, তাঁরাই সব ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা বলেছেন। তাঁরা ইসলামভীতির বিরুদ্ধে সরব। ইসলামের ওপর নগ্ন হামলার আরেকটি কল্যাণকর দিক হলো এতে মুসলমানের আত্মমর্যাদা, আত্মরক্ষার চিন্তা ও দ্বিনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
ভারতবর্ষের কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি অমুসলিম বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের মধ্যে পবিত্র কোরআনের তরজমা ও মহানবী (সা.)-এর জীবনীগ্রন্থ বিতরণ করার পর ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। ইসলাম তার অনুসারীদের ধৈর্য, সহনশীলতা ও ক্ষমার শিক্ষা দেয়, অবিচারের বিপরীতে সুবিচার এবং বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শান্তি ও শৃঙ্খলার নির্দেশ দেয়। মোটকথা পরিবর্তিত পৃথিবীতে বুদ্ধিবৃত্তিক, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সহনশীল পদ্ধতিতে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। (সংক্ষেপিত)
তামিরে হায়াত থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর