জীবন-জীবিকার অনিবার্য বাস্তবতায় কখনো কখনো ঋণ করতে হয়। অন্যের কাছ থেকে ধার করে প্রয়োজন পূরণ করতে হয়। কিন্তু সময়মতো ওয়াদামতো এই ঋণ পরিশোধ করা জরুরি। ঋণ পরিশোধে পড়িমসি করা অপরাধ। ঋণ পরিশোধ না করা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করার নামান্তর। আল্লাহর হক নষ্ট করলে তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা হয়। কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে সংশ্লিষ্ট বান্দার কাছ থেকে ক্ষমা না পেলে ক্ষমা লাভের উপায় নেই। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দুনিয়াতে এই ঋণ আদায় না করলে পরকালে আমলের মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিতে হবে।

এখানে ঋণ পরিশোধ না করার পরিণতি তুলে ধরা হলো—

নিজের নেক আমল পাওনাদারকে দিয়ে দিতে হবে

ঋণ পরিশোধ না করে কেউ মারা গেলে পাওনাদার যদি ঋণগ্রহীতাকে মাফ না করে বা ঋণ মওকুফ না করে অথবা ঋণীর ওয়ারিশরা সেই ঋণ পরিশোধ না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন নেক আমল দানের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের পাপ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা গেলে (কিয়ামতের দিন) তার ঋণ পরিশোধ করার জন্য কোনো দিনার বা দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না; বরং পাপ ও নেকি অবশিষ্ট থাকবে।’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ২২২২)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে, সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয় তার ভাইয়ের পক্ষে তার কাছ থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তাহলে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ এনে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৮৫)

শহীদ হলেও ঋণের গুনাহ মাফ হয় না

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শহীদ ব্যক্তির সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। কিন্তু ঋণ ছাড়া।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৮৬)

অর্থাৎ আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তিও ঋণের পাপ থেকে পরকালে পার পাবে না। তাঁর সব পাপ ক্ষমা করা হলেও ঋণের পাপ ক্ষমা করা হবে না।

ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা গেলে জান্নাতে যাবে না

সামুরা বিন জুনদুব (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের উদ্দেশে খুতবারত অবস্থায় জিজ্ঞেস করেন, অমুক গোত্রের কোনো লোক এখানে আছে কি? কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। এমনকি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করার পর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি উপস্থিত আছি। তখন তিনি বলেন, ‘প্রথম দুই দফায় কিসে তোমাকে সাড়া দিতে বাধা দিয়েছিল? জেনে রেখো! আমি তোমাদের শুধু কল্যাণ কামনা করি। তোমাদের অমুক ব্যক্তি ঋণের দায়ে আটকে আছে। সামুরা (রা.) বলেন, তখন আমি ওই ব্যক্তিকে মৃত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করতে দেখি। যার পর আর কেউ তার কাছে আর কোনো পাওনা চাইতে আসেনি।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৪১)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের আত্মা তার ঋণের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৭৮)

রাসুল (সা.) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাজা পড়তেন না

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর কাছে যখন কোনো ঋণী ব্যক্তির জানাজা উপস্থিত করা হতো, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, সে তার ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ রেখে গেছে কি? যদি বলা হতো যে সে তার ঋণ পরিশোধের মতো সম্পদ রেখে গেছে। তখন তার জানাজার সালাত আদায় করতেন। নতুবা বলতেন, তোমাদের সাথীর জানাজা আদায় করে নাও।’ (বুখারি, হাদিস : ২২৯৮)

আমাদের সমাজের একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না। ফলে এই অপকর্মের খেসারত গুনতে হয় গোটা জাতিকে। এভাবে ঋণখেলাপিরা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করে চলেছেন। যথাযথ আইনের অনুশাসন এবং দ্বিন বিমুখিতাই এই লাগামহীন ঋণখেলাপির মূল কারণ। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, হক্কুল ইবাদ নষ্টকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আর জনগণের সম্পদ লুট করার পরিণাম আরো ভয়াবহ। কেননা ব্যাংক ঋণের সঙ্গে অগণিত মানুষের সম্পদ জড়িত।

মানুষের হক নষ্টকারী এমন মানুষ পরকালে নিঃস্ব হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।