‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারীকা লাকা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে আকাশ-বাতাস। প্রাণোচ্ছল ভালোবাসা ও আনুগত্যের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে মিনার প্রান্তর। দিগন্ত ছাড়িয়ে এ ধ্বনিতে যেন উচ্চাকাশও কেঁপে উঠেছে। জীবনের সকল প্রাপ্তির সম্মিলনেই হজ পালন করছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। আজ শনিবার শুরু হচ্ছে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
আজ ফজরের নামায আদায় করে হজযাত্রীরা মিনা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন তারা। এরপর সেখান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় গিয়ে রাত্রি যাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন। ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরবেন।
এর আগে সারা পৃথিবীর ১৫০টি দেশের ২৫ লাখের বেশি মুসলমান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর নিজ নিজ আবাস এবং মসজিদুল হারাম (কাবা শরীফ) থেকে ইহরাম বেঁধে মক্কা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিনার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। মিনায় যাত্রার মধ্য দিয়ে হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় যা শেষ হবে ১২ জিলহজ শয়তানকে পাথর মেরে।
শনিবার আরাফাতের ময়দানে যাচ্ছেন হাজিরা। বিধি অনুযায়ী, আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুৎবা দেওয়া হবে। হজের খুৎবা শেষে জোহর ও আসরের নামাজ পড়বেন হাজিরা। এ দিন সূর্যাস্তের পর আরাফাত থেকে মুজদালিফায় যাবেন। সেখানে গিয়ে তারা মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন। মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে সারারাত অবস্থানের পর ফজরের নামাজ শেষে বড় জামারায় (প্রতীকী বড় শয়তান) পাথর নিক্ষেপ করতে মিনায় যাবেন তারা।
হাজিরা বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ (সৌদি আরবের তারিখ অনুযায়ী) পর্যন্ত অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়। প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান, এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান। হাজিরা যাতে নির্বিঘ্নে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারেন, সে জন্য ওই জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়।
মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। এ দিনের নাম, ‘ইয়ামুল আরাফা’। হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যারা আগে মদিনায় যাননি তারা মদিনায় যাবেন। সেখানে হাজিরা সাধারণত ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন। পরে শুরু হবে হাজিদের দেশে ফেরার পালা।
ইটিভি সৌদি আরব প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মক্কার আবহাওয়া দফতরের তথ্য মতে শনিবার মক্কার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। আর্দ্রতা থাকবে ৮৫ শতাংশ। আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে, যা হজযাত্রীদের জন্য কিছুটা হলেও আরামদায়ক হবে। হাজিদের নিরাপত্তা দিতে পুরো শহর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলেছে দেশটির নিরাপত্তা রক্ষীরা। হাজিদের সেবায় মিনায় যাওয়া ও আসার পথে কিছুদূর পরপরই রয়েছে হাসপাতাল। সেখানে চলছে সার্বক্ষণিক সেবাদান। হাজিদের যেন কষ্ট না হয় সে জন্য মিনায় যাওয়ার মূল রাস্তাগুলো যানজটমুক্ত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া হাজিরা চৌচালা ঘরের মতো যে তাঁবুগুলোয় থাকছেন তার ভেতর রয়েছে পর্যাপ্ত আলো ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। এ সব তাবুতে রয়েছে শৌচাগার, পানির কল, এমনকি টেলিফোন সংযোগও। বাংলাদেশী হাজিরা যেন ভুল না করেন সে জন্য রয়েছে স্কাউট, হজ গাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও হজযাত্রীদের সহায়ক মিনার তাঁবু নম্বরসংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হয়। মিনায় ২৪/৬২ নম্বর তাঁবু বাংলাদেশ হজ কার্যালয়।
ইসলামের বিধান মোতাবেক, ১০ জিলহজ মিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি (অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন), মাথা মুণ্ডন করা এবং তাওয়াফে জিয়ারত। এরপর ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
উল্লেখ্য, মুসলমানদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ইবাদত বা ধর্মীয় উপাসনা হলো হজ। হজ ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ। আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধারিত সময়। হজ পালনের জন্য বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরী, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন ও অবস্থান করতে হয়। হজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাৎসরিক তীর্থযাত্রা।