মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
বিয়ে মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই বিয়েকে উৎসাহিত করেছে। বিয়ের মাধ্যমে জীবনসঙ্গী হিসেবে নারী-পুরুষ পরস্পরকে বেছে নেওয়ার অধিকার লাভ করে। ইসলাম বিয়েকে ঈমানি দাবি হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সুস্থ, সবল ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য বিয়ে করা আবশ্যক। যেহেতু বিয়ের মাধ্যমে মানুষ জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে, ইসলামী শরিয়ত বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর সাক্ষাৎকে বৈধ করেছে। বরং তাতে উৎসাহিত করেছে। যেন দাম্পত্যজীবনে অতৃপ্তি থেকে না যায়। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা বিয়ে করো সেই স্ত্রীলোককে, যাদের তোমাদের ভালো লাগে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩)
হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, আমি জনৈক নারীকে বিয়ের প্রস্তাব করলাম। রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘তুমি কি তাকে দেখেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাকে দেখে নাও। কেননা এতে তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা জন্মাবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ৩১০৭)অন্য হাদিসে এসেছে, এক লোক নবী কারিম (সা.)-এর নিকট এসে বলল যে, সে আনসারি এক মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে দেখেছ কি? কেননা আনসারদের চোখে দোষ থাকে।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধু দেখাই যথেষ্ট নয়; বরং পাত্র বা পাত্রীর কোনো ত্রুটি আছে কি না, তাও জেনে নেওয়ার অধিকার অন্য পক্ষের রয়েছে। তবে আমাদের সমাজে পাত্রী দেখার যে রীতি রয়েছে, তার পুরোটা ইসলাম অনুমোদিত নয়। যেমন, পাত্রের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন মিলে ১০-১২ জনের একটি দল পাত্রীর বাড়ি যাওয়া এবং সবার সামনে বসিয়ে মাথার কাপড় সরিয়ে, দাঁত বের করে, হাঁটিয়ে দেখা ইত্যাদি। পাত্র ব্যতীত তার পরিবারের অন্য পুরুষদের জন্য পাত্রী দেখার অনুমতি শরিয়ত দেয় না। আর চুল বের করা ও হাঁটানোর মতো বিব্রতকর কাজ অবশ্যই পরিহারযোগ্য।
অনেকেই বিয়ের সময় পাত্রীর সৌন্দর্য ও সম্পদকে বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখে। এ ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চোখে পড়লে মেয়ে ও তার পরিবারের সামনেই মন্তব্য করতে থাকে। যাতে মেয়ের পরিবার কষ্ট পায়, মনঃক্ষুণ্ন হয়। যেমন, মেয়ে কালো, চোখ সুন্দর না, ঠোঁট মোটা ইত্যাদি। ইসলাম এভাবে মন্তব্য করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মিক ও ঈমানের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নারীদের চারটি গুণ দেখে বিয়ে করো : তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার দ্বিনদারি। তবে তুমি দ্বিনদারিকে প্রাধান্য দেবে। নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৯০)
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের নিকট কোনো পাত্র বিয়ের প্রস্তাব দেয়, যার দ্বিনদারি ও চরিত্র তোমাদের যদি পছন্দ হয়, তাহলে তার সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন করো। অন্যথা জমিনে বড় বিপদ দেখা দেবে এবং সুদূরপ্রসারী বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৪-৮৫)
বিয়ের আগে আংটিবদলের পর বা আগে বিয়ের পাত্র-পাত্রীদের একান্তে সময় কাটানোর প্রবণতা সমাজের কোনো কোনো শ্রেণিতে দেখা যায়। ইসলাম আকদের আগে পাত্র-পাত্রীর এভাবে একান্তে সময় কাটানো, ঘুরতে যাওয়া, শপিংয়ে বের হওয়ার অনুমতি দেয় না। কেননা বিয়ের আকদের আগের পাত্র-পাত্রীর পারস্পরিক বা পারিবারিক সিদ্ধান্তের দালিলিক কোনো মূল্য ইসলামী শরিয়তে নেই। দেশীয় আইনেও এমন সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই। তা ছাড়া বিয়েপূর্ব অবাধ মেলামেশা অনেক সময় বিয়ের সম্ভবনা নষ্ট করে। কোনো কারণে বিয়ে না হলে এই মেলামেশা ও সাক্ষাৎ পরস্পরের চরিত্র হননের হাতিয়ার হয়। পাপ ও পাপাচারের আশঙ্কা তো আছেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো নারী-পুরুষ নির্জনে একত্র হয়, তখন সেখানে তৃতীয়জন হয় শয়তান।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৫)
বিয়ের আগে পাত্রীর ছবি হস্তান্তরকেও শরিয়ত নিরুৎসাহ করে। কেননা এতে পাত্রীর ছবি পাত্র ছাড়াও অন্য পুরুষদের সামনে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া বিয়ে না হলে সাধারণত এসব ছবি ফেরত দেওয়া হয় না। যা পরবর্তী সময়ে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ভয় থাকে।