রিক্সাচালকের ছেলে কোটিপতি, পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, রাজনীতিতে এসে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, বর্তমানে মিরপুর-পল্লবীর সাধারণ জনগনের আতঙ্ক এক নাম জুয়েল রানা। সংসদ সদস্য ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লার ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে কাউকে তোয়াক্কা করেন না তিনি। খুন, ধর্ষণ, ভূমিদখল, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অপরাধী হয়ে জেল খেটেছেন একাধিকবার। তবে বেশি দিন জেলে আটকে রাখা যায়নি তাকে। এমপির ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় জেলে যেতে না যেতেই বেরিয়ে আসেন তিনি। সর্বশেষ বিহারি পল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে ১০ জন হত্যার ঘটনায় আলোচনায় আসে এই জুয়েল রানা। রাতারাতি হয়ে যায় টপ অব দি নিউজ। বাউনিয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা জুয়েল রানা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে এলাকাবাসী জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধীক ব্যক্তি জানান জুয়েলের পিতা শাহাবু্দ্িদন একসময় বাউনীয়াবাদ এলাকায় রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীতে কয়েকটি রিক্সা ক্রয় করে ছোট একটি রিক্সা গ্যারেজ চালু করেন। জুয়েল একসময় সেই গ্যারেজেরও রিক্সা দেখাশুনা করতো । অনেকে বলে ২০০৯ সালের পূর্বে জুয়েল নিজেও পল্লবী-কালশী এলাকায় রিকশা চালিয়েছেন।

ওই সময়ে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতেন। একসময় তৎকালীন স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার কামাল মাষ্টারের চোখে আসে। সে থেকে জুয়েল কামাল মাষ্টারের সঙ্গী সাথী হয়ে বিভিন্ন মিছিল মিটিংএ অংশ নিতে থাকে। এলাকাবাসী আরো জানায় জুয়েল কামাল মাষ্টারের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসাবেও কাজ করেছে। কামাল মাষ্টারের বদলতে জুয়েল ওয়ার্ড যুবলীগে নাম লেখায়। কামাল মাষ্টার হটাৎ করে মারা যাওয়ার পর যেন জুয়েলের ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকায়। ক্যাডারি মনোভাব আর দলের সিনিয়রদের মান্য না করার প্রবনতা তাকে রাতারাতি প্রসিদ্ধ করে তোলে। পাশাপাশি দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। দল ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি পাল্টে যায় তার ভাগ্য। অনেক গুলো রিক্সার মালিক হন জুয়েল রানা।

কালশী মোড়ে স্কুলের পাশে গড়ে তোলেন রিকশার গ্যারেজ। এমপি ইলিয়াস মোল্লার কাছের লোক হিসেবে যুবলীগের গত সম্মেলনে যুবলীগ এর কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিস কে ম্যানেজ করে পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নেন। বাউনিয়া বাঁধ, পলাশনগর, রূপনগর, বেগুনটিলা ও লালমাটি এলাকায় সরকারি খাস জমি দখলে নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কালশী বেগুনবাড়ী সংলগ্ন সরকারি জায়গায় গড়ে তুলেছেন রাজু বস্তি। গত কয়েক বছরে কম করেও হলেও প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন জুয়েল রানা। বনানীর ডিওএইচএস এলাকায় রয়েছে তার ফ্ল্যাট। একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। স্থানীয়রা জানান, জুয়েল রানা এখন কালশী এলাকার আতঙ্কের নাম। অভিযোগ রয়েছে, মিরপুর পল্লবী এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা ও বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে মাশোয়ারা আদায় করেন যুবলীগের এ নেতা।

কালশী রোডের ২২তলা গার্মেন্টসটি পুরোটাই একা জুয়েলে রানা নিয়ন্ত্রন করে। ঝুট, কাটপিচ কাপড় ব্যবসা পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করে সে। তবে জুয়েল রানার অত্যাচারের শিকার এসব ব্যবসায়ীরা ভয়ে তার বিরুদ্ধে কখনও থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না। সুত্রে আরও জানা যায়, বাউনিয়া বাঁধ ডি-ব্লকে এক তরুণীকে ধর্ষণও করে জুয়েল রানা। মৃত জামেলা তাঁর পরিবারের সাথে পল্লবী বাউনিয়াবাদের ডি ব্লকের, ২০ নম্বর রোডের, ২৪ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতো। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। সে বরিশাল জেলার আব্দুল মজিদের মেয়ে। বাউনিয়া বাঁধ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা ষষ্ঠ শ্রেণীর ওই ছাত্রী পরে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় তরুণীর মামা আমীর হোসেন বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ জুয়েল রানাকে গ্রেফতার করে।

সে সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলেও রহস্যজনক কারণে রিমান্ডে আনতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে জামিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান জুয়েল রানা। যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা বাহিনীর প্রতিটি কর্মীই ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে হামলার অন্যতম উস্কানিদাতা ও নেতৃত্বদানকারী পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানার নাম এখনও উচ্চারিত হয় এলাকার ক্যাম্পগুলোতে। রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরে তিন ব্যাক্তির কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল একটি পরিবার। ওই টাকার লেনদেন মিটমাট করার কথা বলে পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা সাড়ে পাঁচ কাঠা জমিসহ তাঁদের বাড়ি দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, জুয়েল রানা তাঁদের জিম্মি করে স্ট্যাম্পে সই নিয়ে নেন। নিজের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকার বাড়িটি দখল করে নিয়েছেন তিনি। তবে অভিযুক্ত জুয়েল রানার বক্তব্য, তিনি ১২ লাখ টাকা পান, যে টাকা বাড়িটির বায়না হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্ট্যাম্পের শর্ত অনুযায়ী, ৬৫ লাখ টাকায় বাড়ির দলিল দিতে হবে মালিক পক্ষকে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পল্লবীর পলাশনগর সড়কঘেঁষা ৬ নম্বর প্লটে সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির মধ্যে দোতলা বাড়িটি। এর বড় একটি অংশই খোলা জায়গা।

পারিবারিক ওই সম্পত্তির মালিক কয়েকজন। অন্যতম অংশীদার মাহবুব হাসান জানান, স্থানীয় স্বপন, রিয়াদ ও বাবুর কাছ থেকে তাঁরা ১২ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। ওই লেনদেন মেটানোর নামে জুয়েল রানা ঘোষণা দেন তিনি তিন পাওনাদারকে টাকা দিয়ে দেবেন। তিন ব্যক্তিকে মাহবুব হাসানদের কাছ থেকে টাকা না নিতে বলেন। একদিন অস্ত্র ঠেকিয়ে জুয়েল রানা ও তাঁর লোকজন মাহবুবকে হত্যার হুমকি দিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নেন। ওই চুক্তিতে বলা হয়, ঋণের ১২ লাখ টাকার দায়দায়িত্ব জুয়েল রানার। তিনিই এই টাকা পরিশোধ করবেন। আর সুদ হিসেবে প্রতি মাসে দোতলার দুটি ও নিচতলার একটি রুমের ভাড়া আদায় করবেন ওই যুবলীগ নেতা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মাহবুব হাসান বলেন, ‘প্রভাব খাটিয়ে জুয়েল রানা আমাদের দুই কোটি টাকার সম্পদ দখল করে এ টাকার লেনদেনের একটা নাটক তৈরি করেছে। বাউনীয়াবাদ সহ পল্লবী থানা এলাকায় চাঁদাবাজি, জুট ব্যবসা, জমি দখল, অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন করে তার বাহিনীর মাধ্যমে নানা উপায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেন। ফুটপাত থেকে উঠে আসা এই জুয়েল এর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার কুন্ডের বাজার এলাকায় প্রায় ৫০ (পঞ্চাশ) কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাস বহুল অট্টলিকা করেছেন। যার ছাদের উপরে করা হয়েছে বিদেশী স্ট্যাইলে সুইমিং পুল বলে বিশেষ সুত্রে জানা যায়। বাউনীয়াবাদ এলাকায় রয়েছে তার কয়েকটি বাড়ি ও প্লট, পলাশ নগরে ১৫ কাঠা জয়গা, বাউনীবাদ এর কয়েকটি সরকারী জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন দোকানপাট ও সমিল । এছাড়া সাভার থানার ভাগ্নির বাড়িতে তার স্ত্রী (মালা আক্তার দোলন) এর নামে রয়েছে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি। বিরুলীয়াতে জুয়েলের নিজ নামে জায়গাসহ মোহাম্মদপুরে প্লট রয়েছে বলে জানা যায়। তার ব্যবহারের জন্য রয়েছে চারটি বিলাসবহুল গাড়ী এবং সে নিজে চলে প্রাডো গাড়িতে। স্ত্রী মালা ব্যবহার করেন এক্সকরোলা, ছেলে জিপ গাড়ী ও মেয়ে মিম চলে নোয়া গাড়ীতে। ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার একটি পাজারো গাড়ীও জুয়েল কিনেছে বলে জানাযায়।

বর্তমানে জুয়েলের দক্ষিন হস্ত হিসেবে কাজ করছেন বিগত বিএনপি – জামায়েত সরকারের সময় আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও মতিয়া চৌধুরীর গাড়িতে বোমা হামলাকারী ডাবলু। উক্ত অভিযোগের বিষয় জুয়েল এর নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান তাহার স্ত্রীর নামে সাভারের জমি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। তার গ্রামের বাড়িতে তৈরীকৃত বিলাসবহুল বাড়িটি ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া আছে এবং বাউনীয়াবাদ এলাকায় তার দখলকৃত সরকারী জায়গাগুলি সরকার চাহিবার মাত্র তিনি ছেড়ে দিবেন। তোফায়েল আহমেদ ও মতিয়া চৌধুরীর গাড়ীতে বোমা হামলাকারী ডাবলুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান যে, ডাবলু আমার এলাকার ছেলে আমার কাছে আসতেই পারে এবং এক সঙ্গে ছবি তুলতে পারে কিন্তু আমি তাকে কোন সেলটার দেই না। তিনি আরও বলেন, আমি কামিং কমিশনার। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আমি কমিশনার পদ প্রার্থী ছিলাম। আমার অনেক শত্রু আছে তাহারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এলাকার সচেতন মহল বাউনিয়া পলাশনগর তথা বিহারীদের আতংক তথা পল্লবী আতংক ধর্ষক দখলবাজ যুবলীগ নেতা জুয়েল রানার বিরুদ্ধে দুদক, এনবিআর ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।