করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনফেরত যাত্রীদের পরীক্ষায় গলদের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার কম থাকায় রাতের শিফটে কিছু যাত্রী পরীক্ষা ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে। বিমানবন্দরের হেলথ ডেস্ক ফাঁকা থাকায় চীনফেরত এক যাত্রীর ফেসবুক লাইভের পর টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। দেশের প্রধান বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে তাঁকে সতর্ক করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার, সহকারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
চীন থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, চায়না ইস্টার্ন ও চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের ছয়টি ফ্লাইটে প্রতিদিন ৭০০ জন যাত্রী বাংলাদেশ প্রবেশ করছে। চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসে প্রায় দেড় শ যাত্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে প্রবেশ করেছে বলে মুশফিকা সারা নামের এক যাত্রী অভিযোগ করে ফেসবুকে লাইভ করে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, ‘গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের একটি বিমানে বাংলাদেশে ল্যান্ড করি। চীন থেকে ফেরার সময় সে দেশে দুই দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নই বলে নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর দীর্ঘ দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরও কোনো চেকআপ করা হয়নি।’
বিমানবন্দরে ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে মুশফিকা সারা তাঁর স্ট্যাটাসে আরো লিখেছেন, “দুপুর ২টায় চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসে করে যে চীনা ও বাংলাদেশি নাগরিকরা এসেছে, তাদেরও চেকআপ সম্পন্ন হয়নি। রাত সাড়ে ১২টায় ওই নাগরিকরা ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমিসহ চীনা নাগরিকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষার পরও কাউকে চেকআপ করা হয়নি। পরে জানা যায়, চেকআপ করার চিকিৎসক নেই। বিমান থেকে নামার সময় যে ফরমটি দেওয়া হয়েছিল, সেটিতে ‘ওকে, চেক’ লিখে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার অনুমতি দেন। চীন থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে যে কেউই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কিভাবে নিশ্চিত করল কর্তৃপক্ষ?”
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এভিয়েশন পাবলিক হেলথ (এপিএইচ) ইন্সপেক্টর ও কনসালট্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রউফ মিয়া বেবিচকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘অ্যারাইভাল হেলথ ডেস্কে’ স্বাস্থ্যকর্মী না থাকার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। গত ২ ফেব্রুয়ারি এসংক্রান্ত এক সভায়ও বিষয়টি আলোচনা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্যে এই গাফিলতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বেবিচকের এপিএইচ ইন্সপেক্টর ও কনসালট্যান্টের চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আইকাও নির্দেশিত বিমানবন্দরে প্রবেশসংক্রান্ত নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিমানবন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তাঁর ব্যর্থতার জন্য সতর্ক এবং অ্যারাইভাল হেলথ ডেস্কে যথেষ্টসংখ্যক প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে। যাত্রী, ক্রু ও সর্বসাধারণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হঠাৎ করে আমাদের কাছে চীন থেকে আসা ফ্লাইট কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশ আসে। ইমিগ্রেশন বলছিল, নির্দেশনা এসেছে, আমরা ইমিগ্রেশন করব না। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ায় যাত্রীদের দেরিতে ছাড়া হয়। আগে সকালে ও দুপুরে লোক দিতে পারতাম, রাতে পারতাম না। এখন জনবল বাড়ায় আর কোনো সমস্যা নেই।’
এ ঘটনার পর পরীক্ষা জোরদার করা হয়েছে দাবি করে ডা. শাহরিয়ার বলেন, ‘থার্মাল স্ক্যানার ও ইনফ্রারেড হ্যান্ডহেল থার্মোমিটারে পরীক্ষার পাশাপাশি ডাক্তার বাড়িয়ে ১৯ জন করা হয়েছে। দুজন কোয়ারেন্টাইনে থাকায় ১৭ জন তিন শিফটে কাজ করছেন। এখন প্রতি শিফটে তিনজন করে ডাক্তার থাকবেন। অন্য এয়ারলাইনসেও চীন থেকে আসা শতভাগ যাত্রীকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে চেক করা হচ্ছে। অ্যাম্বুল্যান্স ও ড্রাইভার বাড়ানো হয়েছে।’
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১ ফেব্রুয়ারি রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া যাত্রীর ঘটনায় কিছুটা বিভ্রান্তি ছিল। স্ক্যানিং সবার শতভাগ হয়, এটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ওই দিন ইমিগ্রেশন থেকে একটি ভুল তথ্য দেওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ লোক বাড়িয়েছে, আরেকটু বেশি হলে ভালো হয়। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছি। সবাইকে মানবিক দিক চিন্তা করে কাজ করতে বলেছি। আমরা কোনোভাবেই চাই না কোনো যাত্রীর মাধ্যমে আমাদের দেশে ভাইরাস আসুক।’
জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক তৌহিদ-উল-আহসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবাইকে চেক করা হচ্ছে না, এই ধারণা ভুল। প্রত্যেক যাত্রীকে থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে তাদের অগোচরেই চেক করা হচ্ছে। আর্চওয়ের মতো এই গেট দিয়ে গেলে যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা থেকে থার্মাল ইমেজ আসে। সমস্যা থাকলে ওয়ার্নিং হয়। এর বাইরেও ডাক্তাররা আছেন থার্মোমিটার দিয়ে দেখার জন্য।’ এদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গত ১৬ দিনে (২১ জানুয়ারি-৫ ফেব্রুয়ারি) চীন থেকে সাত হাজার ১৪৬ যাত্রী এসেছে। এদের মধ্যে গতকাল আটজনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।