মহান আল্লাহ সাগরে পানি জমা রেখেছেন। আর সেই সাগরের পানিকে লবণাক্ত বানিয়েছেন। এ জন্য যে যদি এ পানি মিষ্টি বানাতেন, তাহলে কিছুদিন পর এই পানি দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যেত। প্রতিদিন লাখ লাখ প্রাণী তাতে মারা যায়, তা সত্ত্বেও পানিতে কোনো পরিবর্তন আসে না। স্বাদ পরিবর্তন হয় না। তাতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় না। তা নষ্টও হয় না। যদি বলা হতো, যখন পানির প্রয়োজন হবে তখন সমুদ্র থেকে পানি আনতে হবে। তাহলে তা মানুষের জন্য কত কষ্টকর হতো! এ জন্য যে প্রথমত, সবার জন্য সমুদ্রে যাওয়া অসম্ভব ছিল। দ্বিতীয়ত, পানির লবণাক্ততার কারণে তা পান করা ছিল দুষ্কর। তাই আল্লাহ তাআলা এ ব্যবস্থা করেছেন যে সমুদ্র থেকে মনসুনের মেঘ আকাশে তুলে নেন। মেঘের মাধ্যমে যখন সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি আকাশে ওঠে তখন পানির লবণাক্ততা নিচে থেকে যায় এবং শুধু মিঠা পানি ওপরে উঠে যায়। এরপর আল্লাহ তাআলা সেই পানি পরিমাণমতো পাহাড়ে বর্ষণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমাণমতো, অতঃপর আমি জমিনে সংরক্ষণ করি।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ১৮)
পানি পান করার কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে, যা রক্ষা করে পান করলে পানি পান করাও হবে আবার সুন্নতের ওপর আমল করার সওয়াবও পাওয়া যাবে।
পানি পানের শুরুতে বিসমিল্লাহ ও শেষে আলহামদুলিল্লাহ
পানিজাতীয় দ্রব্য পান করার শুরুতে বিসমিল্লাহ ও শেষে আলহামদু লিল্লাহ বলা সুন্নত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা এক চুমুকে উটের মতো পানি পান কোরো না, বরং দুই থেকে তিনবারে (শ্বাস নিয়ে) পান করো। তোমরা যখন পান করবে আল্লাহ তাআলার নাম নেবে তথা বিসমিল্লাহ বলবে এবং যখন পান শেষ করবে তখন আল্লাহর প্রশংসা করবে তথা আলহামদুলিল্লাহ বলবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৮৫)
পানীয় বস্তু তিন শ্বাসে পান
তিন শ্বাসে পানি ইত্যাদি পান করা সুন্নত ও মুস্তাহাব। দুই বা চার শ্বাসে পান করাও জায়েজ। এক শ্বাসে সব পানি পান করে নেওয়া অনুত্তম। নবীজি (সা.) তা অপছন্দ করেছেন।
মানুষ যখন প্রথম এক ঢোক পানি পান করে, এরপর নিঃশ্বাস নেয় তখন তার দেহে এক ধরনের অক্সিজেন প্রবেশ করে। এরপর তিনবার যখন সে এ কাজ করে তখন তার মস্তিষ্কে ও রক্তের শিরা-উপশিরা যথেষ্ট অক্সিজেন লাভ করে, ফুসফুস আরাম পায়, খাদ্য ও শ্বাসনালি নিজেদের সেরা পারফরম করে, পাকস্থলী ধীরে ধীরে সে পানিগুলো রিসিভ করে।
কোনো কিছু পান করার সময় নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হলে পাত্র থেকে মুখ সরিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া উচিত। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে এবং তাতে ফুঁ দিতে বারণ করেছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৮৮)
অনেক বড় পাত্রে মুখ লাগিয়ে পান করা উচিত নয়। জগ ইত্যাদি বড় পাত্রে মুখ লাগিয়ে পান করা মাকরুহ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মশকের মুখ খুলে তাতে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৬২৫)
পানি বসে ও ডান হাতে পান করা মুস্তাহাব। দাঁড়িয়ে ও বাঁ হাতে পান করা মাকরুহ। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৭১৭)
তবে কোনো জায়গায় বসে পান করার ব্যবস্থা না থাকলে দাঁড়িয়ে পান করা মাকরুহ হবে না।
দাঁড়িয়ে পান করার সময় পানি পানের গতি বেড়ে যায়। তাই খাদ্যনালিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছে না। এর ফলে হৃদেরাগ বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে।
একাধিক ব্যক্তিকে পান করানোর সুন্নত পদ্ধতি
কয়েকজন মানুষকে পানীয় পান করানোর ক্ষেত্রে সুন্নত তরিকা হলো, প্রথমে নিজের ডান পাশের জনকে দেবে। তারপর তার পাশের জনকে দেবে, এভাবে দিতে থাকবে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মুখে পানি মেশানো দুধ পেশ করা হলো। তাঁর ডান পাশে ছিল এক বেদুইন ও বাঁ পাশে ছিলেন আবু বকর (রা.)। নবীজি (সা.) দুধ পান করলেন। তারপর বেদুইন লোকটিকে তা দিয়ে বললেন, ডানের লোকের অধিকার আগে। এরপর তার ডানের লোকের। (বুখারি, হাদিস : ৫৬১৯)
জমজমের পানি কিভাবে পান করতে হবে?
জমজমের পানি পান করা সুন্নত। কোনো কোনো আলেমের মতে, জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। (তাহতাবি আলা মারাকিল ফালাহ : ৪৩)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.)-কে জমজমের পানি পরিবেশন করলাম। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় তা পান করলেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪২২)
আবার কারো কারো মতে, অন্যান্য পানির মতো জমজমের পানিও বসে পান করা মুস্তাহাব। রাসুল (সা.)-এর দাঁড়িয়ে পান করার কারণ হলো, জমজম কূপের চারপাশে কাদা ও মানুষের ভিড় ছিল। আর সেখানে বসারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুফতি শফি (রহ.)-এর তাহকিক এটাই যে জমজমের পানিও অন্যান্য পানির মতো বসে পান করাই উত্তম। (ইসলাহী খুতুবাত : ৫/১৯২)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা