সম্প্রতি বজ্রপাতে বাংলাদেশের অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ কী, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না আবহাওয়াবিদরা। তাঁদের মতে, সাধারণত উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হয়। উত্তপ্ত বায়ু যখন দ্রুতগতিতে ঠাণ্ডা হয়, তখন বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। এই বজ্রমেঘের ভেতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষার কণায় পরিণত হয়। বৃষ্টিকণা ও তুষার কণার পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে তুষারের ইলেকট্রন চার্জ ধাক্কা খায়। ফলে স্থির বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। এই চার্জ সঞ্চিত হয়ে তীব্র শব্দের বজ্রপাত সৃষ্টি করে। যখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করে, তখনই তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়। বাতাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত বজ্রবিদ্যুৎ প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উত্পন্ন করে। ফলে বায়ুর দ্রুত প্রসারণ হয় ও তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে বাতাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ যতই দ্রুততর হয়, বজ্রপাত তত বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকালে বজ্রের সৃষ্টি হয়, তখন মেঘের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের সম্প্রসারণ ঘটে। এতে প্রচুর ঝলকানি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে বজ্র। তখন এর সামনে মানুষ বা পশুপাখি যা-ই পড়ে, তার নির্ঘাত মৃত্যু হয়।

এটি বজ্রপাতের বাহ্যিক কারণ। তবে এর মূল কারণ কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, বজ্রপাত আল্লাহ তাআলার শক্তির নিদর্শনগুলোর একটি, যা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাবধান করার জন্য রেখেছেন। তিনি চাইলেই যে কাউকে এর মাধ্যমে যেকোনো সময় শাস্তি দিতে পারেন। যদিও সব ক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা এমনটি করেন না। যা আল্লাহ তাআলা নিজেই পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেছেন, ‘বজ্র তাঁরই তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতাগণও (তাসবিহরত রয়েছে)। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান, তারপর যার ওপর ইচ্ছা একে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহ সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড। (সুরা রা’দ, আয়াত : ১৩)

মানুষের কাজকর্মই বজ্রপাতের মূল কারণ। খোদাদ্রোহিতা, জিনা, ব্যভিচার, পরকীয়া, অন্যায়-অত্যাচার দুনিয়ায় যত বাড়বে, ততই দুনিয়ার বুকে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ বাড়বে। কিন্তু কী করব! আমরা তো অতি আধুনিক হতে গিয়ে আল্লাহকে নিয়ে কটাক্ষ করা শিখে গেছি। নিজেদের জ্ঞানী হিসেবে জাহির করার জন্য রাসুলের বিরোধিতা করতে আমরা ভীষণ পছন্দ করি। (নাউজুবিল্লাহ্!) এককথায় বলতে গেলে ধর্মকে কটাক্ষ করাটা এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, এখন খোদাদ্রোহিতার ট্রেন্ড পার করছি আমরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার দাবিদাররাও এই ঘৃণ্য কাজে আত্মনিয়োগ করে ফেলেছেন। একাধিক জেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে খবরের কাগজে পাওয়া যায়। যাঁদের কাছে মানুষ হওয়ার জন্য আমাদের মা-বাবা আমাদের শরণাপন্ন করলেন, তাঁদের অবস্থাই যদি এই হয়, তবে আমাদের অবস্থা যে কী হবে তা বোঝাই যাচ্ছে।

উপরোক্ত আয়াতটির শেষাংশে [আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহর সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তার শক্তি অতি প্রচণ্ড।] এ ধরনের অতি আপডেট ব্যক্তিদের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

প্রতিকারের উপায়
কিন্তু আমরা যদি এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ থেকে সরে এসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কানে ধরে তাওবা করতে পারি, তাহলে হয়তো এ ধরনের দুর্যোগ থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে—হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, সকালবেলায় সূর্য দিতাম এবং কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শুনাতাম না। (মুসনাদে আহমদ : ৮৭০৮)

বজ্রপাত অবস্থায় করণীয়
বজ্রপাত খোদায়ি দুর্যোগ, এর থেকে বেঁচে থাকার কিছু বাহ্যিক করণীয়ও রয়েছে, যা ইদানীংকালে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তবে হাদিসের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায়, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রিয় নবী (সা.) তাঁর উম্মতদের বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আ-ফিনা কবলা জালিকা।’ (তিরমিজি : ৩৪৫০)

অন্য রেওয়ায়েতে আছে, হজরত ইবনে আবি জাকারিয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’, সে বজ্রে আঘাতপ্রাপ্ত হবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২৯২১৩)

বজ্রপাতে নিহত মানুষের লাশ চুরি
কখনো কখনো শোনা যায়, বজ্রপাতে নিহত মানুষের লাশ চুরি করে এক শ্রেণির অসাধু মানুষরা তা চড়া মূল্যে বিক্রি করে দেয়, যা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। অথচ মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আদম সন্তানকে দেওয়া হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত তথা শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদা। তাদের জীবিত অবস্থায় যেরূপ সম্মান রয়েছে, মৃত্যুর পরও অনুরূপ সম্মান আছে। তাই শরিয়তে যেমন একজন জীবিত মানুষকে অসম্মান করা নিষেধ, তদ্রূপ মৃত ব্যক্তির সঙ্গেও মর্যাদাহানিকর কোনো আচরণ সম্পূর্ণ হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃতদের দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা কোরো না। বরং তাদের ভালো বিষয়গুলো আলোচনা করো।’ (তিরমিজি ৩/২৩৮)

মৃত মানুষের লাশ যে কতটা সম্মানিত, তা বোঝাতে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে—‘মৃত লাশের হাড্ডি ভাঙা জীবিত মানুষের শরীরের হাড্ডি ভাঙার মতো জঘন্য কাজ।’ (আবু দাউদ শরিফ) এমনকি লাশের প্রতি এ পরিমাণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে দীর্ঘদিন আগে কবরস্থ লাশ, যা হয়তো বা মাটিও হয়ে গেছে, এরপর ওই কবরকে অসম্মান করা এমনই গুনাহ, যেমন একজন জীবিত মানুষ শুয়ে থাকা অবস্থায় তার অসম্মান করা গুনাহ। হাদিস শরিফে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কবরের ওপর বোসো না।’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর বসার চেয়েও জঘন্য হলো তোমার মৃত মুমিন ভাইয়ের কবরের ওপর বসা।’ কেননা তাতে ওই কবরবাসীকে অসম্মান করা হয়ে থাকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক