আজ বুধবার মাহে রমজানের ২৬ তারিখ। আজ দিবাগত রাতই লাইলাতুল কদর। এ লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্য একটা পুণ্যময় রজনী। বছর ঘুরে ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে, আল্লাহ পাক যে একটি রাত ইবাদত-বন্দেগিতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে গৌরবময় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী। কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী। মহান আল্লাহ এ রজনীর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর আপনি কি জানেন কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতার রুহ [জিবরাইল (আ.)] অবতীর্ণ হন, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)
‘লাইল’ ও ‘কদর’ দুটি শব্দই আরবি। ‘লাইল’ শব্দের অর্থ রাত। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান। পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো সম্মানিত রাত। তবে কদর শব্দের অর্থ আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, মাহাত্ম্য, তাকদির, আদেশ ইত্যাদিও হতে পারে। লাইলাতুল কদরকে শবেকদরও বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফারসি। এর অর্থও রাত। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী এ জন্য বলা হয় যে মানবজীবনের জন্য এ রাত অত্যন্ত মূল্যবান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) বলেছেন, এ মহান রাতে ইবাদতের কারণে এমন লোকেরও মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়, ইতিপূর্বে যাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান ছিল না। তাই এ রাতকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়।
‘কদর’ শব্দের অন্য অর্থ হচ্ছে আদেশ ও তাকদির। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লেখা থাকে, তা এক রমজান থেকে অপর রমজান পর্যন্ত সরবরাহের হুকুম ও দায়-দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর এক বর্ণনা মতে, শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে আল্লাহ তাআলা এক বছরের জন্য বান্দার রুজি-রিজিক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তাকদিরি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর শবেকদরে সেসব সিদ্ধান্তের প্রয়োগ এবং রুজি-রিজিক প্রভৃতি সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের দিয়ে থাকেন। (তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড ২০, পৃষ্ঠা ১১৫)
লাইলাতুল কদর কোরআন নাজিলের রাত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হা-মিম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ১-৪)
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার মাস ইবাদত করে যে সওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদতে তার চেয়ে বেশি সওয়াব হয়। লাইলাতুল কদরের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন লাইলাতুল কদর উপস্থিত হয় তখন জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের একটি বিরাট দল নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং বসা ও দাঁড়ানো যেকোনো অবস্থায় আল্লাহর জিকিরে মগ্ন বান্দাদের অভিবাদন জানান এবং তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষণের জন্য দোয়া করেন।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস ২০৯৬)
সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় নামাজ পড়ে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস ২০১৪)
আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশ দিন শুরু হলে রাসুল (সা.) লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন। রাত জাগতেন এবং নিজের পরিবার-পরিজনকেও জাগাতেন।’ (বুখারি, হাদিস ২০২৪)
লাইলাতুল কদরের সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। হাদিসে এসেছে, উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বলেন, একবার নবী (সা.) আমাদের লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। তখন দুজন মুসলিম ঝগড়া করছিল। অতঃপর (বিবাদ নিরসনের পর) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের লাইলাতুল কদরের সংবাদ দেওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুকের ঝগড়া-বিবাদের কারণে নির্দিষ্ট তারিখের জ্ঞান আমার অন্তর থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। সুতরাং তোমরা এ রাতকে ২৯, ২৭ ও ২৫ তারিখের রজনীতে অনুসন্ধান করো। (বুখারি, হাদিস ২০২৩)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের শেষ ১০ দিনে বিজোড় রাতে তোমরা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।’ (বুখারি, হাদিস ২০১৭)
তবে হাদিসে এ রাতের কিছু বৈশিষ্ট্য এসেছে। সেই রজনী চন্দ্রালোকিত রজনীর মতো উজ্জ্বল, পরিষ্কার, নীরব ও নাতিশীতোষ্ণ হবে। সকাল পর্যন্ত কোনো তারকা খসে পড়বে না। পরের দিন সকালের সূর্যকিরণ পূর্ণিমার চাঁদের মতো উষ্ণতাহীন হবে। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস ২২৭৬৫)
লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর পেয়ে থাকি তাহলে সে রাতে কী দোয়া করব? জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাঅফু আন্নি।’
অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন। (তিরমিজি, হাদিস ৩৫১৩)
এই রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ রাতে বেশি বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত করুন। কোরআন তিলাওয়াতের সওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে ব্যক্তি এর বদলে একটি নেকি লাভ করবে। আর একটি নেকি হলো ১০ নেকির সমান।’ (তিরমিজি, হাদিস ২৯১০)
হাদিসে আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা কোরআন পড়ো। কেননা কোরআন কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য সুপারিশ করবে। (মুসলিম, হাদিস ৮০৪)
আজকের এ পুণ্যময় রজনী লাইলাতুল কদর অবহেলায় না কাটিয়ে সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার নির্দেশ রয়েছে। এ রাতে মাগরিব, ইশা, তারাবি ও ফজরের নামাজ আদায় করার পাশাপাশি প্রচুর নফল নামাজ, জিকির-আজকার, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, দান-খায়রাত, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা প্রার্থনা, মৃত মাতা-পিতা, উস্তাদ, আত্মীয়-স্বজন এবং সব মুমিন-মুসলিমের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা উচিত।
আসুন, আমরা আজকের এ মোবারক রাত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করি।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি
বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়