মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

রাতের শেষাংশ অত্যন্ত বরকতময়। রাতের নামাজ বা তাহাজ্জুদের নামাজ আল্লাহর একটি প্রিয় ইবাদত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘তারা রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত ও দাঁড়িয়ে রাত্রি যাপন করে।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৬৪)

নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ সবচেয়ে মর্যাদাবান নামাজ। হাদিসে এসেছে, এই সময় আল্লাহ তাআলা জমিনের আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দাদের তাঁর কাছে চাইতে বলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আমাদের রব প্রত্যেক রাতে যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন। আল্লাহ বলেন, কে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে চাইবে? আমি তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯৪)

সাহাবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁরা নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। হিরাক্লিয়াসের বাহিনী মুসলমানের কাছে পরাজিত হলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের পরাজয়ের কারণ কী? তখন তাদের এক নেতা বলল, কারণ তারা রাতে (তাহাজ্জুদের) নামাজ পড়ে আর দিনে রোজা রাখে। (ইবনে আসাকির, ১/১৪৩)

আবু বকর (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ

আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসুল (সা.) বেরিয়ে আবু বকর (রা.)-কে নিঃশব্দে কেরাত পড়তে দেখলেন। অতঃপর ওমর (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে সশব্দে কেরাত পড়তে দেখলেন। অতঃপর তাঁরা উভয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে একত্র হলে রাসুল (সা.) বললেন, হে আবু বকর! আমি তোমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তুমি নিঃশব্দে কেরাত পড়ছিলে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাঁকেই শোনাচ্ছিলাম, যাঁর সঙ্গে চুপিসারে কথা বলছিলাম। অতঃপর তিনি ওমর (রা.)-কে বললেন, আমি তোমার পাশ দিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তুমি সশব্দে কেরাত পড়ছিলে। তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসুল! আমি ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগাতে এবং শয়তানকে তাড়াতে চেয়েছিলাম। হাসান বসরি (রহ.)-এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুল (সা.) বললেন, হে আবু বকর! তোমার কেরাত একটু শব্দ করে পড়বে এবং ওমর (রা.)-কে বললেন, তোমার কেরাত একটু নিচু স্বরে পড়বে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩২৯)

ওমর (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ

যায়েদ ইবনে আসলাম (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) সারা রাত নামাজ পড়তেন আর রাতের শেষাংশে পরিবারের লোকজনকে নামাজের জন্য জাগিয়ে দিতেন। আর তিনি এই আয়াত পড়তেন, ‘তুমি তোমার পরিবারকে নামাজের আদেশ দাও এবং তার ওপর দৃঢ় থাকো; আমি তোমার থেকে কোনো রিজিক চাই না বরং আমিই তোমাকে রিজিক দেব।’ (মুয়াত্তা মালেক)

ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ওমর (রা.) এশার নামাজ পড়ার পর নিজ ঘরে সারা রাত নামাজ পড়তেন।

উসমান (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ

ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের দিন তাঁর এক স্ত্রী বলল, তোমরা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, যিনি এক রাকাতে পুরো কোরআন খতম করে তাঁর রাত কাটাতেন। (আজ-জুহুদ, পৃষ্ঠা ১২৭)

আবু হুরায়রা (রা.)-এর রাতের ইবাদত

আবু হুরায়রা (রা.) নামাজি ও রোজাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

সব সময় তাঁর পরিবারে কেউ না কেউ নামাজে থাকত। আবু উসমান নাহদি বলেন, একবার আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর ঘরে মেহমান হই। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও সেবক মিলে রাতের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করে নেন। পর্যায়ক্রমে তাঁরা সারা রাত নামাজ পড়েন। (আল ইসাবাহ : ৪/২০৯)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর রাতের ইবাদত

ওমর (রা.) বলেন, এক রাতে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.) ও আমি হাঁটছিলাম। দেখলাম আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) মসজিদে নামাজ পড়ছেন। তখন রাসুল (সা.) তাঁর কেরাত শুনে বললেন, কোরআন যেমন সবুজ-সতেজ অবতীর্ণ হয়েছে, কেউ যদি তেমনিভাবে কোরআন পাঠ করে আনন্দিত হতে চায় তাহলে সে যেন ইবনে উম্মে আব্দের (ইবনে মাসউদ) মতো কোরআন পাঠ করে। (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ২/১৮৬)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ

রাসুল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বললেন, আবদুল্লাহ কতই না ভালো মানুষ যদি সে রাতে তাহাজ্জুদ পড়ত। এর পর থেকে তিনি রাতে খুব কম ঘুমাতেন। প্রতি রাতে ঘুম থেকে উঠে ফজর পর্যন্ত তিনি তাহাজ্জুদ পড়তেন। নাফে বলেন, যদি কখনো ইবনে ওমর (রা.)-এর এশারের নামাজ ছুটে যেত তাহলে তিনি সারা রাত নামাজ পড়ে কাটিয়ে দিতেন। (আল ইসাবা : ২/৩৪৯)

আনাস (রা.)-এর রাতের ইবাদত

আনাস (রা.) দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। আবার তিনি পুরো রাতকে তিন ভাগে ভাগ করে নেন। প্রথমাংশে তিনি নিজে নামাজ পড়তেন। এরপর তাঁর স্ত্রীকে জাগিয়ে দিতেন দ্বিতীয়াংশে নামাজ পড়ার জন্য। তারপর তাঁর স্ত্রী মেয়েকে জাগিয়ে দিতেন শেষাংশে নামাজ পড়ার জন্য।

তামিম দারি (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ

তামিম দারি (রা.) তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি এক আয়াত দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। (আল-ইসাবাহ : ১/১৮৪)

তিনি শুধু নামাজ পড়ার হুল্লা (ইউনিফর্ম জাতীয় বিশেষ কাপড়) কেনেন।

আবাদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, তামিম দারির ইবাদত সম্পর্কে আমার কাছে যে পরিমাণ হাদিস বা খবর পৌঁছেছে অন্য কারো সম্পর্কে তা পৌঁছেনি। (আজ-জুুহুদ, পৃষ্ঠা ১৯৯)

হাসান-হুসাইন (রা.)-এর রাতের ইবাদত

হাসান (রা.) রাতের শুরুর ভাগে তাহাজ্জুদ পড়তেন আর হুসাইন (রা.) রাতের শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। গঠনগত ও চারিত্রিক গুণে তাঁরা উভয়ে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। (আজ-জুহুদ, পৃষ্ঠা-১৭১)