সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানি নদভি
আল্লাহ মুসলমানের সাফল্য ও সম্মানজনক জীবন লাভের জন্য দুটি বিষয় আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। এক. জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ময়দানে বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনগুলো গ্রহণ করা, দুই. ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করা। মুসলিম সমাজের সর্বত্র যখন এ দুটি নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়েছিল, তখন সম্মান ও সাফল্য তাদের হাতে ছিল। আর যখন তারা দুটি নির্দেশনা বা কোনো একটি নির্দেশনার ক্ষেত্রে ত্রুটি করেছে সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তারা। মুসলিম ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। বিশেষত ইসলামের প্রাথমিক যুগের একাধিক ঘটনায় এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দুই বিষয়ে সর্বোচ্চ যত্নশীল ছিলেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞার ব্যবহার দেখা যায় খন্দকের যুদ্ধে। তিনি মদিনায় শত্রুদের অনুপ্রবেশ ও সম্ভাব্য হামলা রোধ করতে পরিখা খনন করেছিলেন। অথচ আরবে এ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। এটা ছিল পারস্যের রীতি। সালমান ফারসি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পরিখা খননের পরামর্শ দেন এবং মহানবী (সা.) তা গ্রহণ করেন।
উহুদের যুদ্ধে শত্রুর গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখতে তাদের অবস্থানের কাছাকাছি একটি ছোট পাহাড়ের টিলায় মুসলিম বাহিনীর একটি ছোট দল নিয়োগ দেওয়া হয়। যেন তারা শত্রুর ওপর দৃষ্টি রাখতে পারে এবং তার মুসলিম বাহিনীর ওপর পেছন থেকে হামলা করতে না পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ জাগতিক কৌশল ও অবলম্বন এটা ভেবে ছেড়ে দেননি যে মুসলিমদের মধ্যে তাঁর নবী আছে এবং মুসলিম বাহিনীর সব সদস্য আল্লাহর সৎ বান্দা। সুতরাং আল্লাহ সাহায্য করবেন এবং সতর্কতার প্রয়োজন নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উপায়-অবলম্বন পুরোপুরি গ্রহণ করতেন এবং আল্লাহর কাছেও বিনীতভাবে প্রার্থনা করতেন, সাহায্য চাইতেন। তাঁর দোয়া ও প্রার্থনা দেখে মনে হতো তিনি যেন একেবারেই উপায় ও অবলম্বনহীন। তাই তিনি আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা, আল্লাহর ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতেন।
ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে ওপরের দুটি পথ অনুসরণ বা ছেড়ে দেওয়ার পরিণামে ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি দেখা গেছে। মুসলিম জাতি যখন জাগতিক উপায় ও অবলম্বন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে এবং আল্লাহর বিধানের আনুগত্য ও তার প্রতি নির্ভরশীল রয়েছে, তখন তারা সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করেছে। আর যখন দুটি বিষয়ের কোনোটিতে ত্রুটি চলে এসেছে, তখন তাদের ব্যর্থতা তাদের স্পর্শ করেছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দ্বিনি কাজ ও সংগ্রামে এ দুটি পদ্ধতিই অনুসরণ করতেন। উহুদের ময়দানে জাগতিক উপায়-অবলম্বন ও সতর্কতায় ত্রুটি আসায় বড় ধরনের বিপদ ও সাময়িক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বহু সাহাবি শহিদ হন এবং স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সা.) আহত হন। অন্যদিকে হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর কারো কারো মনোযোগ আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ থেকে সরে যাওয়ায় মুসলিম বাহিনী সাময়িক পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। অথচ হুনাইনের যুদ্ধে মুসলমানের বাহ্যিক উপায়-উপকরণের অভাব ছিল না। সুতরাং মুসলিমরা কখনোই আল্লাহ বিমুখ হতে পারে না।
অনুরূপ সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) একটি শক্তিশালী মুসলিম সেনা দল নিয়ে পারস্য বাহিনীর মুখোমুখি হন। মধ্যখানে দজলা নদী ছিল। তখন সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, বাহিনীর লোকরা যেন গুনাহে লিপ্ত না হয়। এতে আল্লাহর সাহায্যের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি সমীক্ষা করে দেখলেন বাহিনীর সদস্যরা দ্বিনের ব্যাপারে যত্নশীল। এর পরই নদী পার হওয়ার নির্দেশ দেন এবং সহজেই তা পার হয়ে যান। তারা এত দ্রুত নদী পার হন যে শত্রুপক্ষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে; বরং বলা যায়, মুসলিমরা যখন আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল হয় এবং উপায়-অবলম্বন গ্রহণেও ত্রুটি করে না, তখনই তাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হয়। সাহাবিদের পরবর্তী যুগের ইতিহাসেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলিম উম্মাহের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলেও বিপর্যয় ও পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে উল্লিখিত দুটি বিষয়ের অভাবই পাওয়া যাবে। কোথাও মুসলিমরা হয়তো দুটি বিষয়ই ছেড়ে দিয়েছে আবার কোথাও দুটি কারণের একটি অনুপস্থিত। তাই জাতির উন্নয়নে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, উপায়-উপকরণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং একই সঙ্গে আল্লাহর কাছে জাতির উন্নয়নে দোয়া ও প্রার্থনা, পরিশুদ্ধ ঈমান ও আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা অর্জন করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ যেমন বলেছেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করতে আল্লাহর শত্রুদের ও তোমাদের শত্রুদের।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৬০)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯)
তবে সাফল্যের দুটি চাবিকাঠির মধ্যে ঈমান ও আল্লাহর আনুগত্যই অগ্রাধিকার পাবে। উপায়-অবলম্বন ও জ্ঞান-প্রজ্ঞার ব্যবহারে মুমিন যথাসাধ্য সচেষ্ট হবে। ঈমান ও আনুগত্যে মুমিন যখন পূর্ণ নিষ্ঠাবান হবে, তখন উপায়-উপকরণের ছোট ছোট অপূর্ণতা আল্লাহ পূর্ণ করে দেবেন। যেমন বদর যুদ্ধে আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে প্রস্তুতি থাকার পরও সম্মিলিত বাহিনীর বিপরীতে মুসলিমরা দুর্বল ছিল। কিন্তু আল্লাহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে দুর্বল করে দেন। বর্তমান যুগের শক্তিমত্তার উৎস শিক্ষা ও গণমাধ্যম। সুতরাং মুসলিম উম্মাহকে সেদিকেই মনোযোগ দিতে হবে। অথচ মুসলিম উম্মাহ যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উপায়-অবলম্বনে পিছিয়ে আছে, তেমনি তাদের ঈমান ও আল্লাহর ওপর আস্থা অর্জনের প্রশ্নে দুর্বলতম জায়গায় রয়েছে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। তিনিই সর্বজ্ঞাতা ও উত্তম কর্মবিধায়ক। আমিন।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর