আতাউর রহমান খসরু 

নবুয়ত লাভের পর মহানবী (সা.) দীর্ঘ এক যুগ মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের অবস্থা অনেকটা নুহ (আ.)-এর গোত্রের মতো ছিল, যাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘নুহের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছিল, যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনো ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা করে তজ্জন্য তুমি দুঃখী হয়ো না।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৬)

হজের সময় ইসলামের দাওয়াত : মহানবী (সা.) হজের সময় মক্কায় আগত বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের বাণী নিয়ে হাজির হন। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘হে অমুক, অমুকের বংশধর! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। তোমাদের এসব প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা আমাকে সমর্থন করো, আমার প্রতি ঈমান আনো এবং আমাকে জুলুম থেকে রক্ষা করো আর আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিতে পারি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা : ১১১)

আবু লাহাবের অপতৎপরতা : রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতেন, তখনই আবু লাহাব সেখানে উপস্থিত হয়ে বলত, ‘হে অমুক গোত্র! সে তোমাদের আহ্বান করছে তোমরা লাত ও উজ্জার পূজা ও বিশ্বস্ততার শিকল নিজেদের গলা থেকে ছুড়ে ফেলো এবং নিজেদের সাহায্যকারী জিনদের সঙ্গেও সম্পর্ক ত্যাগ করে সেই বিদআত ও বিভ্রান্তি গ্রহণ করো, যা সে নিয়ে এসেছে। অতএব, তোমরা তাঁর কথা মানবে না, তাঁর কথা শুনবে না।’ (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা : ১৫৭)

কোরআনে নাজরানবাসীর প্রশংসা : মক্কাবাসীর বহুমুখী অপতৎপরতার পরও বিভিন্ন গোত্রের এক বা একাধিক ব্যক্তি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন—নাজরানের একটি খ্রিস্টান কাফেলা মক্কায় গমন করে। এই কাফেলায় ১২ জনের মতো সদস্য ছিল। তারা হাবশার খ্রিস্টানদের কাছে আগেই ইসলাম সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। আবু লাহাব এসে তাদের ইসলামবিমুখ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। পবিত্র কোরআনে তাদের প্রশংসায় ইরশাদ হয়েছে, ‘এর আগে আমি যাদের কিতাব দিয়েছিলাম তারা এতে বিশ্বাস করে। যখন তাদের কাছে এটা আবৃত্তি করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি, এটা আমাদের প্রতিপালক থেকে আগত সত্য। আমরা তো আগেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম। তাদেরকে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে, যেহেতু তারা ধৈর্যশীল এবং তারা ভালোর দ্বারা মন্দের মোকাবেলা করে, আর আমি তাদের যে জীবিকা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে। তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে, তখন তারা তা উপেক্ষা করে চলে এবং বলে, আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য; তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সঙ্গ চাই না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫২-৫৫)

বিভিন্ন গোত্র থেকে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন : এ সময় একাকী ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন সুওয়াইদ ইবনে সামিত (রা.), ইয়াজ ইবনে মুয়াজ (রা.), আবু জর গিফারি (রা.), তোফায়েল ইবনে আমর দাওসি (রা.), জিমাদ আজদি (রা.) প্রমুখ।

আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী তাঁদের পরিচয়ও উল্লেখ করেছেন। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো—

১. সুওয়াইদ ইবনে সামিত (রা.) : তিনি ছিলেন মদিনার ইয়াসরিবের অধিবাসী। বুদ্ধিমত্তা, কাব্যচর্চা, আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার কারণে তাঁর গোত্রের মানুষ তাঁকে ‘কামিল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি হজ বা ওমরাহ করতে মক্কায় এলে মহানবী (সা.) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং কোরআন তিলাওয়াত করে শোনান। নবুয়তের একাদশ বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

২. ইয়াজ ইবনে মুয়াজ (রা.) : নবুয়তের একাদশ বছর ‘বুয়াস’ যুদ্ধের কিছুকাল আগে তিনি আউসের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মক্কায় আসেন। তারা মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী খাজরাজের বিরুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার আশায় মক্কায় এসেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের ইসলামের দাওয়াত দিলে ইয়াজ (রা.) তা গ্রহণ করেন।

৩. আবু জর গিফারি (রা.) : তিনি গিফার গোত্রের লোক ছিলেন। নবীজি (সা.)-এর আবির্ভাবের খবর পেয়ে তিনি প্রথমে তাঁর ভাইকে মক্কায় পাঠান। পরে নিজেই উপস্থিত হন। মক্কায় পৌঁছার পর আলী (রা.)-এর সহযোগিতায় তিনি নবীজি (সা.)-এর কাছে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর আবু জর (রা.) মক্কাবাসীকে ইসলামের আহ্বান জানালে তারা তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করে।

৪. তোফায়েল ইবনে আমর দাওসি (রা.) : তিনি নিজ গোত্রের নেতা ও কবি ছিলেন। তাঁর গোত্র ইয়েমেনের একটি অংশ শাসন করত। নবুয়তের একাদশ বর্ষে তিনি মক্কায় এলে মক্কাবাসী তাঁর কাছে মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সতর্ক করে যেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে। তাদের কথায় তোফায়েল (রা.) কৌতূহলী হলেন এবং নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করেন। নবীজি (সা.) তাঁর সামনে ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরেন এবং কোরআন পাঠ করে শোনান। ফলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজ গোত্রে ইসলাম প্রচার করেন। খন্দকের যুদ্ধের পর নিজ গোত্রের ৮০টি পরিবারসহ তিনি মদিনায় হিজরত করেন।

৫. জিমাদ আজদি (রা.) : তিনি ইয়েমেনের আজদ শানওয়াহ গোত্রের লোক ছিলেন। ভূত তাড়ানোর কাজ করতেন। মক্কায় আসার পর স্থানীয় অবিশ্বাসীরা মহানবী (সা.)-কে পাগল হিসেবে উপস্থাপন করে। তিনি নবীজি (সা.)-এর চিকিৎসা করার জন্য হাজির হলেন। কিন্তু নবীজি (সা.)-এর কথা শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১১১-১১৪)

যেসব গোত্র নবীজির আহ্বানে সাড়া দেয়নি : বিপরীতে মহানবী (সা.) এ সময় বনু কিলাব, বনু হানিফা, বনু আমের ইবনে সা’সাআ, কিন্দা, মোহারেবব ইবনে খাসাবা, ফাজারাহ, নাসসান, মায়রা, সালিম, আবাস, বনু নসর, বনু আলবাকা, হারিস ইবনে কাআব, হাদারিমা প্রভৃতি গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান। কিন্তু তাদের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ১৪৭)