প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও।’ (তাবরানি)। এটি হাদিস কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কথাটা খুবই চকমপ্রদ। এ বাণীটি যেমন দূরত্বের বিবেচনায়, তেমনি বাস্তবিক দিক থেকেও যৌক্তিক।
চীনে মুসলমানদের অস্তিত্ব ইসলামের বিশ্বজনীনতার পরিচায়ক। এখানেই কবির কণ্ঠে শোনা যায় সাম্যের বিজয়গাথা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অমীয় বার্তা : ভারত চীন আরব ভূমি/মুসলিম আমি—/সারা বিশ্বই আমার জন্ম ভূমি।’ (ভাবানুবাদ—আল্লামা ইকবাল)।
চীনে ইসলামের প্রবেশ ঘটে ব্যবসায় ও ধর্মীয় প্রচারণার পথে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চায়নিজ স্বকীয়তায় এখানে মুসলমানরা দেশীয় নামে পরিচিত হয় বেশি। তাদের থাকে পারিবারিক পরিচিতিতে আরবি নাম। এতে বোঝা যায়, মুসলমানদের উদারতা ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
সত্য কথা বলতে কী, জ্ঞানের প্রয়োজনে চীন ভ্রমণের সুবাদেই চীনে ইসলাম বিস্তার সম্ভব হয়। একটি সূত্রে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ৬২৬ বা তৃতীয় হিজরির কাছাকাছি সময়ে ইসলাম প্রচারকরা চীন উপকূলে অবতরণ করেন। তাঁদের দলনেতা ছিলেন হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.)। তাঁর সঙ্গে আরো তিনজন বিশিষ্ট সাহাবি ছিলেন। তিনি ক্যান্টন বন্দরে অবস্থান করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি এখনো সমুদ্রতীরে মিনার উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এর অদূরেই রয়েছে তাঁর ও কয়েকজন সাহাবির পবিত্র মাজার।
আবার কোনো কোনো গবেষকের মতে, হিজরি ষষ্ঠ সালে প্রিয়নবী (সা.) একটি প্রতিনিধিদল চীনে পাঠান। তৎকালীন সম্রাট তাদের সাদরে গ্রহণ করেন এবং মসজিদ নির্মাণ ও ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। ১৩৩৫ খ্রি. চীন সম্রাট ইসলামকে ‘সত্য ও বিশুদ্ধ ধর্ম’ (True and pure religion) বলে ঘোষণা করেন।
চীন বিশ্বের অন্যতম জনসংখ্যাবহুল দেশ। চীনে মুসলিমরা তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। কম-বেশি চীনের সবখানেই মুসলমান রয়েছে, তবে তাদের অধিকাংশের বাস সিন জিয়াংয়ে। তবে চীনের হুই, উইঘুর, কাজাক, উজবেক, তাজিক, তাতার, কিরগিজ, ডোংসিয়াং, সালার, বোনান প্রভৃতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা বেশি। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে চীনের মুসলমানদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং তারা চীনে ছোট-বড় নানা রকম মসজিদ তৈরি করেছেন। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীনে ৩০ হাজারের বেশি মসজিদ রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের আর্থিক সংস্থার সহায়তায় চীনে এ শতাব্দীর শুরুতে (২০১৪) একটি অত্যাধুনিক শিল্পকলা, কারুকার্যমণ্ডিত ও বেশ ব্যতিক্রমধর্মী একটি বৃহৎ মসজিদ নির্মিত হয়। এখানে একসঙ্গে ছয় হাজার মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া চীনে বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদ রয়েছে।
হুয়াইশেং মসজিদের মিনার ও প্রবেশপথ
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মিত হুয়াইশেং মসজিদ বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম। মসজিদটি আনুমানিক ১৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। চীনা ভাষায় হুয়াইশেং অর্থ ‘পবিত্রতাকে স্মরণ করুন’। এ জন্য মসজিদটিকে ‘স্মরণী মসজিদ’ বা Memorial Mosqueবলা হয়। মসজিদটি ‘নূর টাওয়ার মসজিদ’ নামেও সুপরিচিত। কেননা প্রাচীনকালে এ মসজিদের সুউচ্চ মিনারে স্থাপিত বাতি বা ফানুস দেখে পার্শ্ববর্তী ঝুজিয়াং নদীতে চলাচলকারী নাবিকরা নৌপথের নির্দেশনা পেতেন। এ জন্য মসজিদটিকে ‘বাতিঘর মসজিদ’ও বলা হয়।
হুয়াইশেং মসজিদের মিনার নির্মিত হয়েছিল আজান দেওয়ার প্রয়োজনে। ৩৬ ফুট উঁচু এ মিনারটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানের জন্যও ব্যবহৃত হতো। অগ্নিকাণ্ডসহ নানা বিপর্যয়ে হুয়াইশেং মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ১৩৫০ ও ১৬৯৫ সালে এটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তবে মসজিদের প্রাচীন মিনারটি এখনো অক্ষত আছে।
নিউজি মসজিদ
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রাচীন ও সুন্দরতম মসজিদের নাম নিউজি মসজিদ। চীনা রাজবংশ ‘চিং’-এর রাজা ‘কাংশি’র শাসনামলে ৯৯৬ সাল বা হাজার বছর আগে মসজিদটি নির্মিত হয়। শুক্রবার জুমার নামাজে এখানে মুসল্লির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর দৈনিক অন্তত ২০০ মুসল্লি এখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। মসজিদটি চীনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে, যার বাইরের দিকে রয়েছে কাঠের অপরূপ প্রলেপ।
বস্তুত কৃষ্টি-সংস্কৃতি, মানববিদ্যা, আধুনিকতা ও জাতিগত সংহতিতে চীনের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বিশ্ববাসীকে হাতছানি দেয়। এ জন্যই চীন ভ্রমণে জ্ঞানের দরজা খুলে যায় এবং মনের জানালায় দেখা দেয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। চীনের মসজিদ নির্মাণেও লেগেছিল সমকালীন নির্মাণশৈলীর ছোঁয়া। সেখানে প্রাচীন মসজিদগুলো কাঠ দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এসব মসজিদে ইসলামী ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের পাশাপাশি ড্রাগন ও কচ্ছপের মতো চীনা ঐতিহ্যেরও সমন্বয় লক্ষ করা যায়। প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যবিদরা বৌদ্ধ ধর্মের নির্মাণশৈলীও সানন্দে গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা এখানেই থেমে থাকেননি বরং চীনে মুসলমানদের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী স্থাপত্যশৈলীও পূর্ণমাত্রায় বিকাশিত হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া, ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর।