প্রতিবছর পালিত হয় মে দিবস। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের কাছে এ দিনটি যেমন আনন্দ ও বেদনার, তেমনি প্রেরণা ও আবেগের। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে আত্মদান করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এখন দুনিয়ার প্রতিটি দেশে মে মাসের ১ তারিখ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গুরুত্বসহকারে পালন করে আসছে শ্রমিক দিবস। মে দিবস এলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ঘর্মাক্ত মেহনতি মানুষের প্রতিচ্ছবি। শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিও উঠে আসে সবার সামনে।

সভ্যতার শুরু থেকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সৃষ্টি হয় কর্মক্ষেত্রের। কেউ মালিক হিসেবে, আবার কেউ বা শ্রমিক হিসেবে তৎপর হয়েছে কর্মক্ষেত্রে। শ্রমিক বা মেহনতি মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে অন্যের জমিতে, প্রতিষ্ঠানে বা কলকারখানায় শ্রম দিত। বিনিময়ে পেত মজুরি। তবে মালিকরা বেশির ভাগই ছিলেন লোভী। বেশি বেশি সম্পদ অর্জন ছাড়া মালিকরা কিছুই বুঝতেন না। এ জন্য তাঁরা শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি দিতেন না। মালিকের কাছে বলতে গেলে শ্রমিকের কোনো দামই ছিল না। শ্রমিকরা সব সময় মালিকের অবজ্ঞা ও নিপীড়নের শিকার হতো। শ্রমিকের গায়ের ঘাম ও সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিকদের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠত। অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকরা কাটাত দুর্বিষহ জীবন। তখন শ্রমিকের জন্য কাজের নির্দিষ্ট সময় ছিল না। এমনকি ছিল না মজুরির কোনো নিয়ম-কানুন। কখনো শ্রমিকরা ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মালিকের কাজ করত। শ্রমিকের শ্রমকে এভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করে মালিকরা অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ। ফলে মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকের ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ পেত।

এই ক্ষোভ ও হতাশার কারণে শ্রমিকরা প্রায়ই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত। তবে মালিকরা ক্ষমতাশালী ও অর্থশালী হওয়ার কারণে শ্রমিকরা পেরে উঠত না। তার পরও শ্রমিকরা থেমে যায়নি। ১৮৮৪ সালের ঘটনা। আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব লেবার’ ওই বছরের ৭ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের দাবি তুলল। তবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মানল না। তারা শক্ত অবস্থান নিল। ফলে একসময় শ্রমিকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করল। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরি করাসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে হে মার্কেটের শিল্প শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। তিন লাখ শ্রমিক এই ধর্মঘটে যোগ দিলে কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শিকাগোর হে মার্কেটের বিশাল সমাবেশে মালিকপক্ষ ও পুলিশ হামলা চালালে ১১ জন শ্রমিক মারা যায়। তা ছাড়া শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করার অপরাধে শ্রমিকনেতা ‘আগস্ট স্পিজ’সহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তারপর প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করে সরকার ১৮৮৭ সালে আগস্ট স্পিজসহ ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করে। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন স্তব্ধ করা যায়নি। মালিকরা বাধ্য হয়েই অনেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শ্রম সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ শুরু করে। তবে মেহনতি মানুষের প্রকৃত মজুরির বিষয়ে সামান্য অগ্রগতি হলেও শ্রমমূল্য সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি।

এদিকে শিকাগোর রক্তঝরা শ্রমিক আন্দোলন একটি সফল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে সময় নেয়নি। মাত্র চার বছর পর ১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসে শিকাগোর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের জন্য এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই বছরের ১ মে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘শ্রমিক দিবস’ পালনের ঘোষণা করা হয়। এভাবেই শুরু হয় মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ফলে ১৮৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১ মে শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে আসছে। সময়ের পরিবর্তনে মে দিবস এখন সারা দুনিয়ার কাছে গৃহীত ও সমাদৃত। মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেরণায় কলকারখানা, অফিস-আদালতসহ সব কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা এখন উজ্জীবিত। যে উদ্দেশ্যে শ্রমিকরা আন্দোলন করে জীবন দিয়েছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত কাজের সময়সূচি এখন প্রায় সব কর্মক্ষেত্রে পালন করা হচ্ছে। মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারেও সঠিক নিয়ম-নীতি আজকাল মোটামুটিভাবে মানা হয়। তার পরও ক্ষেত্রবিশেষে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা যে নেই তা বলা যাবে না।

সত্যি কথা বলতে কী, শ্রমিক দিবস কাগজে-কলমে একটি আন্তর্জাতিক দিবস হলেও এর স্লোগান যতটা না চমৎকার, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ও তাদের মানবিক দিক বিবেচনায় ততটা সফল নয়। আজও শ্রমিক শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। নিশ্চিত হয়নি শ্রমিকের বেঁচে থাকার অধিকার। শ্রমিকরা আগের মতো দাস-দাসী বিবেচিত না হলেও মালিকরা শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত হয়নি। শ্রমিকরা পায়নি কাজের উন্নত পরিবেশ। ফলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো প্রায়ই শ্রমিক বিক্ষোভ ও আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের তৈরি পরিকল্পনা ও দর্শন শ্রমিকের আসল সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কেননা যাঁরা শ্রমিকের জন্য আইন ও বিধান তৈরি করছেন, তাঁরা নিজেরাই শোষক ও ধনিকশ্রেণির লোক অথবা মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামই শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় আগমন করেন। তখন খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ ছিল উপেক্ষিত ও অবহেলিত। আল্লাহর নবী (সা.) শ্রমিকের মেহনতের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য তিনি শ্রমিকদের সামাজিকভাবে মর্যাদা দিয়ে এবং নিজে শ্রম দান করে মালিকের কৃত্রিম অহংবোধ ও আভিজাত্য গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শ্রমিক ও শ্রমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর অমোঘ বাণী ও প্রণীত নীতি আজও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অনন্যসাধারণ আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আলোকে মহানবী (সা.) যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছিলেন, তা শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে দেখিয়েছিল প্রকৃত মুক্তির পথ। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক এবং দুই পক্ষের কর্তব্য ও অধিকার ন্যায়নীতি ও সমতার মাপকাঠিতে নির্ধারণ করেছে ইসলাম। শ্রমিক-মালিক নিছক প্রভু ও ভৃত্যের মতো নয়; বরং এটিকে ভাই ভাই সম্পর্ক বলে অভিহিত করেছেন মহানবী (সা.)। আল্লাহর নবী (সা.) বলেন,  ‘যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন।’ (বুখারি শরিফ)

আল্লাহর নবী (সা.) শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে অন্য এক হাদিসে উল্লেখ করেছেন, ‘তোমরা যা খাবে, তা থেকে তাদের (শ্রমিককে) খাওয়াবে এবং যা পরিধান করবে, তা তাকে পরিধান করতে দেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে ইসলামের নীতি হলো, ‘শ্রমিক নিয়োগ করলে তার মজুরি কত হবে, তা অবশ্যই তাকে জানিয়ে দিতে হবে।’ (হিদায়া)

একই কথা মহানবী (সা.) অন্য এক হাদিসে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদের কোনো রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জানো না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্ট বোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা দেখাও না।’ (বুখারি)

শ্রমিকরাও মানুষ। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও মানবিক অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখার বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মজুরদের সাধ্যের অতীত কোনো কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয়, তবে নিজে সাহায্য করো।’ (বুখারি)

শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত না করার পরিণাম সম্পর্কে মহানবী (সা.) কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কঠিন অভিযোগ উপস্থাপন করব—যে ব্যক্তি কাউকেও কিছু দান করার ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, কোনো মুক্ত-স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে, যে তার মূল্য আদায় করে এবং যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের কাজে নিযুক্ত করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিল, কিন্তু তার মজুরি দিল না, ওরাই সেই তিনজন।’ (মিশকাত)

শ্রমিকদের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহর নবী (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, ‘মজুর-চাকরদের অপরাধ ৭০ বার পর্যন্ত ক্ষমা করে দাও।’ (তিরমিজি)

শ্রমিকের মজুরি যথাসময়ে পরিশোধ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মজুরকে তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি পরিশোধ করে দাও।’ (ইবনে মাজাহ)

শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর এই বাণী শ্রমিকের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

প্রতিবছর মে দিবস এলে নানা আয়োজনে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ নানা ধরনের সভা-সমাবেশ। সেখানে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বলা হয় অনেক কথা। অথচ শ্রমের মূল্য নিয়ে, মজুরি ও সুবিধা নিয়ে আজও ছিনিমিনি খেলেন মালিকরা।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মালিক-শ্রমিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা অবশ্যই সুরক্ষিত হবে। দূর হবে মালিক-শ্রমিক বিরোধ, আর প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রমের সত্যিকার মর্যাদা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সিনিয়র ব্যাংকার